Wednesday, May 25, 2016

ইসলামে হালাল রিজিক উপার্জনের গুরুত্ব ও বিধি-বিধান



আল্লাহ তায়ালা অসংখ্য-অগণিত নিয়ামতের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছেন আমাদের। খাদ্য-পানীয়, আলো-বাতাস, জীবন-জীবিকা সবই তিনি আমাদের দিয়েছেন সুচারুরূপে। একজন মানুষ জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মহান আল্লাহ তায়ালার অসংখ্য-অগণিত নেয়ামতে লালিত-পালিত হয়; যার সঠিক পরিসংখ্যান সম্ভব নয়। জীবনধারণের উপকরণ সন্ধান করা ইসলামি শরিয়তের একটি স্পষ্ট নির্দেশ। মানবআত্মা প্রকৃতিগতভাবে রিজিক অন্বেষণের পেছনে ছুটে চলে। আর আল্লাহ তায়ালা দিনকে করেছেন জীবিকা অর্জনের সময়কাল এবং রাতে বানিয়েছন বিশ্রামের সশয় হিসেবে। তিনি মানুষকে নির্দেশ দিয়েছেন ভূপৃষ্ঠে বিচরণ করতে এবং তার দেয়া রিজিক ভোগ করতে। হালাল রিজিক উপার্জন করে মানুষের দ্বারস্থ হওয়ার থেকে বেঁচে থাকাই বিশাল সম্মান ও মর্যাদার বিষয়।
আল-কোরানে হালাল রিজিক উপার্জন প্রসঙ্গ
এক. পবিত্র কোরানে আল্লাহ মহান ইরশাদ করেন, আর পৃথিবীতে কোনো বিচরণশীল নেই, তবে সবার জীবিকার দায়িত্ব আল্লাহ নিয়েছেন, তিনি জানেন তারা কোথায় থাকে এবং কোথায় সমাপিত হয়। সবকিছুই এক সুবিন্যস্ত কিতাবে রয়েছে।'[সুরা-হুদ, আয়াত-৬]
দুই. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন, অতঃপর নামাজ সমাপ্ত হলে তোমরা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড় এবং আল্লাহর অনুগ্রহ তালাশ কর ও আল্লাহকে অধিক স্মরণ কর,তোমরা সফলকাম হবে।’ [সুরা-আল-জুমা, আয়াত-১০]
তিন. আল্লাহ বলেন, হে বিশ্ববাসীগণ,তোমরা আল্লাহকে ভয় করো। আর সুদের যা বকেয়া আছে তা পরিহার করো; যদি তোমরা বিশ্বাসী হও। কিন্তু যদি তোমরা তা না করো তাহলে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের সাথে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও।’ [সুরা বাকারা-২৭৯]
চার. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে রাসুলগণ, তোমরা পবিত্র ও ভালো বস্তু থেকে খাও এবং সৎকর্ম কর। নিশ্চয় তোমরা যা কর সে সম্পর্কে আমি সম্যক জ্ঞাত। [সুরা আল-মুমিনুন :৫১]
পাচ. আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘হে মুমিনগণ, আহার কর আমি তোমাদের যে হালাল রিজিক দিয়েছি তা থেকে এবং আল্লাহর জন্য শোকর কর, যদি তোমরা তারই ইবাদত কর। [সুরা বাকারা:১৭২]
আল-হাদিসে হালাল রিজিক উপার্জন প্রসঙ্গ
এক. ইবনে মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেন, রাসুলুল্লাহ সা. বলেছেন, আল্লাহর নির্ধারিত রিজিক পূর্ণমাত্রায় লাভ না করা পর্যন্ত কোনো জীবজন্তুই মারা যায় না। সাবধান! আল্লাহকে ভয় কর এবং বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জনের চেষ্টা কর। রিজিক প্রাপ্তিতে বিলম্ব যেন তোমাদের তা উপার্জনে অবৈধ পন্থা অবলম্বনে প্ররোচিত না করে। কেননা আল্লাহর কাছে যা রয়েছে, তা কেবল তার আনুগত্যের মাধ্যমেই লাভ করা যায়। [ইবনে মাজা]
দুই. আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ [রা.] থেকে বর্ণিত,নবী [সা.] ইরশাদ করেন, কোনো ব্যক্তি হারাম পন্থায় সম্পদ উপার্জন করে, তা থেকে দান-খয়রাত করলে তা কবুল করা হবে না এবং সে তার এ সম্পদে বরকত প্রাপ্ত হবে এরূপ কখনো হতে পারে না। তার পরিত্যক্ত হারাম মাল কেবল তার জন্য দোজখের পাথেয় হতে পারে (তা দিয়ে আখেরাতের সৌভাগ্য ও সাফল্য অর্জন করা যায় না)। আল্লাহতায়ালার নিয়ম হচ্ছে, তিনি মন্দের দ্বারা মন্দকে নিশ্চিহ্ন করেন না (হারাম মালের দান দ্বারা গুনাহ মাফ করেন না)। বরং ভালো দ্বারা মন্দ নিশ্চিহ্ন করেন (হালাল মালের দান দ্বারা গুনাহ মাফ করেন। নাপাক দ্বারা পবিত্রতা অর্জন করা যায় না। (মুসনাদে আহমাদ)।
তিন. নবী আকরাম [সা.] একটি হাদিসে বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের রুজি রোজগারের জন্য কাজ করে এবং সে কাজে লক্ষ্য থেকে আল্লাহর সন্তুটি অর্জন, তার দৃষ্টান্ত হজরত মুসা আ:-এর মায়ের মতো। তিনি নিজেরই সন্তানকে দুধ পান করান আবার তার বিনিময় লাভ করেন।
চার. শরিয়তের দৃষ্টিতে রিজিক অন্বেষণে শ্রম ব্যয়ের গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে নবিজি [সা.] বলেছেন, ‘নিজ হাতে উপার্জিত খাদ্য সর্বোত্তম খাদ্য’।
পাচ. রাসুলে করিম [সা.] হাদিসে পাকে ইরশাদ করেন, ‘হালাল রিজিক অন্বেষণ করা ফরজ আদায়ের পর আরেক ফরজ। [তিবরানি ও বায়হাকি শরিফ]
হালাল রিজিক অন্বেষণ করাও একটি ইবাদত
আল্লাহই রিজিকের মালিক। কে কী উপার্জন করবে তা আল্লাহতায়ালা নির্ধারণ করে রেখেছেন। বান্দার উচিত হবে বৈধ পন্থায় আয়-উপার্জন করার প্রয়াসে নিয়োজিত থাকা। হালাল এবং হারামের পার্থক্য সম্পর্কে সতর্ক থাকা। কোনোভাবেই হারাম পথে প্রলুব্ধ না হওয়া। হারাম পন্থায় জীবিকা উপার্জনের দ্বারা কোনো ইবাদাত কবুল হবে না। বিষয়টিকে আমাদের অধিক গুরুত্ব দিতে হবে তা হলো, আমরা যা উপার্জন করছি তা পবিত্র কি-না, হালাল কি-না। কেননা আল্লাহ তায়ালা যা পবিত্র ও হালাল কেবল তাই ভক্ষণ করার নির্দেশ দিয়েছেন।
হালাল রিজিক অন্বেষণ করা কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয়
পবিত্র ও হালাল রিজিক অন্বেষণ-উপার্জন করা আদৌ কোনো ঐচ্ছিক বিষয় নয় রবং টি একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ ও আবশ্যিক বিষয়। কারণ কেয়ামতের ময়দানে বান্দাকে তার জায়গা থেকে এক চুল পরিমাণও নড়তে দেয়া হবে না যতক্ষণ না সে এই প্রশ্নের উত্তর প্রদান করতে পারবে যে, সে তার জীবিকা কীভাবে অর্জন করেছে এবং কোথায় তা ব্যয় করেছে। তাই প্রত্যেক মুসলমানের ইমানি কর্তব্য হলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করা যে, সে তার জীবিকা কীভাবে উপার্জন করছে! সে যা উপার্জন করছে তা হালাল কি-না, পবিত্র কি-না তা অবশ্যই যাচাই করতে হবে।
ইবাদত কবুল হওয়ার পূর্বশর্ত হালাল রিজিক
প্রসিদ্ধ সাহাবি হজরত সাহল ইবনে আবদুল্লাহ [রা.] বলেন, মুক্তি বা পরিত্রাণ লাভ তিনটি বিষয়ের ওপর নির্ভরশীল- ১. হালাল খাওয়া ২. ফরজ আদায় করা এবং ৩. রাসুলে করিম [সা.]-এর সুন্নতগুলোর আনুগত্য বা অনুসরণ করা। হালাল খাদ্য গ্রহণের মধ্যে ব্যক্তিজীবনের নামাজ, রোজা, হজ, জাকাত, দান-খয়রাত, লেনদেনসহ যাবতীয় নেক আমল কবুল হওয়ার সমূহ আশা বিদ্যমান এবং হারাম খাদ্যের প্রতিক্রিয়ায় তা কবুল না হওয়ার প্রবল আশঙ্কাই রয়েছে। এ ব্যাপারে উম্মতকে সতর্ক করতে রাসুল [সা.] ইরশাদ করেন, ‘বহু লোক এমন দীর্ঘ সফর করে আসে এবং অত্যন্ত ব্যাকুলভাবে দুহাত তুলে আল্লাহর দরবারে বলতে থাকে, হে পরওয়ারদেগার! রব! কিন্তু যেহেতু সে ব্যক্তির পানাহারসামগ্রী হারাম উপার্জনের, পরিধেয় পোশাক-পরিচ্ছদ হারাম পয়সায় সংগৃহীত, এমতাবস্থায় তার ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা কী করে কবুল হতে পারে?’ অন্যত্র তিনি ইরশাদ করেন, যে ব্যক্তি হারাম মালের এক লোকমা তার পেটে ঢোকাবে, ৪০ দিন পর্যন্ত তার নামাজ-রোজা, ইবাদত-বন্দেগি কবুল হবে না [তিরবানি শরিফ]
হালাল উপার্জন করার গুরুত্ব ও মহাত্ম্য
হালাল খাওয়ার বরকত ও হারাম খাওয়ার অকল্যাণ, অপকারিতা আর অনিষ্টতার প্রতি গুরুত্বারোপ করতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা তাঁর কালামে পাকে সুরা বাকারার ১৭২ নম্বর আয়াতে ইমানদারদের সম্বোধন করে বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! তোমরা হালাল ও পবিত্র বস্তু-সামগ্রী আহার করো, যেগুলো আমি তোমাদের রুজি হিসেবে দান করেছি এবং শুকরিয়া আদায় করো আল্লাহর, যদি তোমরা তাঁরই বন্দেগি করো।’ আলোচ্য আয়াতে কারিমার তাফসির পেশ করতে গিয়ে জগদ্বিখ্যাত আলেম মুফতি শফী (রহ.) তাঁর কালজয়ী ‘তাফসিরে মা’আরেফুল কোরআন’ তাফসির গ্রন্থে বলেন, ‘আলোচ্য আয়াতে যেভাবে হারাম খাওয়ার প্রতি নিষিদ্ধারোপ করা হয়েছে, ঠিক সেভাবে হালাল ও পবিত্র খানা খেতে এবং তা খেয়ে শুকরিয়া আদায় করতে অনুপ্রাণিত করা হয়েছে। কারণ হারাম খেলে যেমন মন্দ অভ্যাস ও অসৎ চরিত্র সৃষ্টি হয়, ইবাদতের আগ্রহ স্তিমিত হয়ে আসে, দোয়া কবুল হয় না, তেমনিভাবে হালাল খানায় আল্লাহ প্রদত্ত বরকত আর রহমত থাকার দরুন অন্তরে এক ধরনের নূর সৃষ্টি হয়, যা দ্বারা অন্যায় ও বদ চরিত্রের প্রতি ঘৃণা জন্মায় এবং সততা-সাধুতা ও উত্তম চরিত্রের প্রতি আগ্রহ বৃদ্ধি পায়; ইবাদত-বন্দেগির প্রতি অধিক মনোযোগ আসে, পাপের কাজে মনে ভয় আসে এবং ইবাদত, দোয়া ও মোনাজাত কবুল হয়। আর এ কারণেই আল্লাহ তাঁর সব নবী-রাসুলের প্রতি হেদায়েতস্বরূপ ইরশাদ করেন, হে আমার রাসুলগণ! তোমরা পবিত্র খাদ্য গ্রহণ করো এবং নেক আমল করতে থাকো [সুরা মুমিনুন, আয়াত ৫১]
দুনিয়ার মোহে অন্ধ হয়ে হালাল-হারামের বাছবিচার না করে, হক-হালাল না চিনে যে যেভাবে পারছি টাকা উপার্জনের পেছনে ছুটছি। সুদ, ঘুষ, চুরি, বাটপাড়ি, খুন, হত্যা, সিনেমা, গান, রাহাজানি, জবরদখল- এমন কোনো ঘৃণ্য পন্থা নেই, যা আমরা অবলম্বন করছি না। হিসাব করে দেখছি না ক্ষণিকের সুখ আর দুদিনের দুনিয়ার পেছনে পড়ে কিভাবে আখিরাতের অফুরন্ত সম্ভাবনাকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। একবারও ভেবে দেখছি না, এ হারাম উপার্জনের কারণে আমার ইবাদত-বন্দেগি, নামাজ-রোজা, দান-খয়রাত সব বরবাদ হয়ে যাচ্ছে।?

No comments:

Post a Comment