ফিত্রা কী জিনিস?
রমযান
মাসের সিয়ামের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার
প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমানের যে খাদ্য
সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে- শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিতর বা
ফিত্রা বলা হয়ে থাকে।
ফিত্রা প্রদানের হুকুম কী?
ফিত্রা দেয়া ওয়াজিব।
কোন ব্যক্তির উপর ফিত্রা দেয়া ওয়াজিব?
প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন, ধনী-গরীব সকলের উপর ফিত্রা দেয়া ওয়াজিব।
কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে ফিতরা দেয়া ফরয হয়?
ঈদের
দিন যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজনীয় খাবারের চেয়ে
অতিরিক্ত আরো ২ কেজি ৪০ গ্রাম পরিমাণ নির্দিষ্ট খাবার মওজুদ থাকে তাহলে ঐ
ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের সকল সদস্যদের উপর ফিত্রা প্রদান ফরয হয়ে যাবে।
(ক) আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু
আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাধীন,
কৃতদাস, নারী, পুরুষ, ছোট, বড় প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি রমাযানের সিয়ামের
কারণে এক সা‘আ খেজুর বা এক সা‘আ যব ফিত্রা হিসেবে ফরয করে দিয়েছেন।
(বুখারী : ১৫০৩; মুসলিম : ৯৮৪)
(খ) আহমাদের একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে,
فِيْ زَكَاةِ الْفِطْرِ عَلَى
كُلِّ حَرٍّ وَعَبْدٍ ذَكَرٍ وَأُنْثَى صَغِيْرٍ أَوْ كَبِيْرٍ فَقِيْرٍ
أَوْ غَنِىٍّ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ
প্রত্যেক স্বাধীন, পরাধীন, নারী, পুরুষ
ছোট, বড়, ফকীর-ধনী, প্রত্যেকের উপর জনপ্রতি এক সা‘আ (২ কেজি ৪০ গ্রাম)
পরিমাণ খেজুর ফিত্রা হিসেবে দান করা ওয়াজিব।
তবে ইমাম আবূ হানীফার (রহ.) মতে ঈদের দিন
যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অর্থাৎ ঐদিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত
হিসেবে যার ঘরে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমপরিমাণ
নগদ অর্থ থাকবে শুধু ঐ পরিবারের উপর ফিত্রা দেয়া ফরয হবে।
যে দরিদ্র ব্যক্তি ফিত্রা গ্রহণ করবে সেও কি তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ফিত্রা প্রদান করবে?
না, দিবে না।
ফিত্রা কাকে দিব?
যারা যাকাত খেতে পারে তাদেরকেই ফিত্রা দেবেন।
একাধিক লোকের ফিত্রা কি একজন দরিদ্রকে দেয়া জায়েয?
হা, তা জায়েয। অপরদিকে এক ব্যক্তির ফিত্রা ভাগ করে একাধিক লোককে দেয়াও জায়েয আছে।
ফিত্রা হিসেবে কী ধরনের খাদ্যদ্রব্য দেয়ার বিধান আছে?
গম, ভুট্টা, যব, খেজুর, কিসমিস, পনির, আটা, চাউল ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য।
প্রতি একজনের উপর কী পরিমাণ ফিত্রা দেয়া ফরয?
এক সা‘আ পরিমাণ। আলেমদের মতে সা‘আর সমপরিমাণ হল ২ কেজি ৪০ গ্রাম।
(ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ
الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ
تَمَرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أقط أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيْبٍ
‘আমরা ফিত্রা দিতাম মাথাপিছু এক সা‘আ
পরিমাণ খাদ্য বা এক সা‘আ যব বা এক সা‘আ খেজুর বা এক সা‘আ পনির বা এক সা‘আ
কিসমিস’। (বুখারী : ১৫০৬; মুসলিম : ৯৮৫)
(খ) নাসাঈর অন্য এক হাদীসে আছে
صَدَقَةُ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ
ফিত্রা হচ্ছে এক সা‘আ পরিমাণ খাদ্যবস্তু।
এ মাসআলাটি মতবিরোধপূর্ণ। ইমাম আবূ হানিফা
(রহ.) বলেছেন, ফিতরার পরিমাণ অর্ধেক সা‘ অর্থাৎ ১ কেজি ২০ গ্রাম
খাদ্যদ্রব্য। উলামায়ে কিরাম অনেক যাচাই বাছাই করে দেখেছেন যে, অর্ধেক সা‘
এর পক্ষের অধিকাংশ হাদীসই দুর্বল। সে কারণে সক্ষম ব্যক্তিদের এক সা‘ পরিমাণ
ফিত্রা প্রদান করাই আমি (লেখক) উত্তম মনে করছি।
খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে এর বদলে টাকা পয়সা দিয়ে কি ফিত্রা দেয়া জায়েয হবে?
মালিকী,
শাফেয়ী ও হাম্বালী এ তিন মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন, যেহেতু হাদীসে
খাদ্যদ্রব্য দান করতে বলা হয়েছে সেহেতু টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্রা দিলে তা
জায়েয হবে না। কিন্তু কিয়াসের আলোকে হানাফী মাযহাবে টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্রা
দেয়াকে জায়েয বলেছেন। বিবেকের বিশ্লষণে আপনি যে কোন একটা মত গ্রহণ করতে
পারেন।
ফিত্রা কোন সময় প্রদান করব?
ফিত্রা
দেয়ার দু’টি সময় আছে : একটি হল উত্তম সময়, অন্যটি হল বৈধ সময়। উত্তম সময়
হল ঈদের দিন ঈদের সালাত আদায় করার পূর্বে ফিত্রা প্রদান শেষ করা। আর জায়েয
সময় হল ঈদের দু’এক দিন আগেই ফিত্রা প্রদান করে ফেলা। ইবনু ‘উমার বলেছেন,
أَنَّ النَّبْيَّ -صلى الله عليه وسلم- أَمَرَ بِزَكَاةِ الْفِطْرِ قَبْلَ خُرُوْجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম
লোকদের ঈদের সালাত আদায় করার আগেই ফিত্রা দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন।
(বুখারী : ১৫০৯; মুসলিম : ৯৮৬)
ফিত্রা প্রদানের ফরয সময় কখন শুরু হয়?
ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।
যদি কোন ব্যক্তি ঈদের সালাত আদায়ের পর ফিত্রা প্রদান করে তাহলে কি তা আদায় হবে?
সালাত
আদায়ের পূর্বে হলে তা ফিৎরা হিসেবে গণ্য হবে। আর সালাতের পর হলে তা হবে
সাধারণ দান। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
زَكَاةُ الْفِطْرِ طُهْرَةٌ
لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطَعْمِهِ لِلْمَسَاكِيْنَ -
فَمَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاَةِ فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُوْلَةٌ وَمَنْ
أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاَةِ فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنْ صَدَقَاتٍ
সিয়াম পালনকারীর অপ্রয়োজনীয় ও বেফাস
কথাবার্তা থেকে তাকে পবিত্রকরণ এবং গরীব মিসকীনদের খাবার প্রদানের
উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিত্রা প্রদান করাকে ফরয
করে দিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে তা পরিশোধ করবে সেটা
ফিত্রা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর ঈদের সালাতের পর দিলে তা হবে
একটা সাধারণ দান খয়রাত। (অর্থাৎ তা ফিত্রা হিসেবে গণ্য হবে না)। (আবূ দাউদ
: ১৬০৯; ইবনে মাজাহ : ১৮২৭)
ঈদের দিন সূর্যোদয়ের আগে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তার কি কোন ফিত্রা দেয়া লাগবে?
হা,
লাগবে। তবে সেদিন সূর্যোদয়ের পর ভূমিষ্ট হলে ফিত্রা দেয়া লাগবে না। তবে
দিয়ে দিলে সাওয়াব হবে। অনুরূপভাবে ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে কেউ
ইন্তেকাল করলে তার ফিত্রা দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন সূর্যাস্তের পর মারা
গেলে তার পক্ষে ফিত্রা দিতে হবে। কারণ ফিত্রা প্রদানের ফরয সময় শুরু হয়
ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।
ঈদের সালাতের সময় কখন শুরু ও শেষ হয়।
সূর্যোদয়ের
পনর/বিশ মিনিট পর থেকে যোহরের সালাতের পনর/বিশ মিটিন পূর্বে পর্যন্ত ঈদের
সালাতের সময় যাকে এ সময়টি সালাতুদ দুহা (অর্থাৎ চাশতের সালাতের) সময়। এ
চাশতের সালাত আর ঈদের সালাতের সময় একই।
হাদীসে আছে,
عَنْ جُنْدُبٍ قَالَ كَانَ
النَّبِيُّ -صلى الله عليه وسلم- يُصَلِّيْ بِنَا الْفِطْرَ وَالشَّمْسَ
عَلٰى قَيْدِ رَمْحَيْنِ وَالأَضْحَى عَلَى قَيْدِ رَمْحٍ
জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত,
তিনি বলেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে ঈদুল
ফিতরের সালাত আদায় করতেন সূর্য যখন দু’ বর্শা পরিমাণ উপরে উঠত এবং ঈদুল
আয্হা আদায় করতেন সূর্য যখন এক বর্শা পরিমাণ উপরে উঠত। (ফিকহুস সুন্নাহ :
১/৩১৯)
No comments:
Post a Comment