হজরত আদম (আ.) এর জীবদ্দশায় তার বংশধরদের ধর্মবিশ্বাসে কোনো ধরনের শিরক বা
কুফরের সংমিশ্রণ ছিল না। তারা সবাই একত্ববাদের (তাওহিদ) অনুসারী ছিলেন। আদম
(আ.) এর শরিয়তের অধিকাংশ আদেশ-নিষেধ ছিল বৈষয়িক বিষয়ে। কারণ পৃথিবীকে নতুন
করে আবাদ করতে এবং এটিকে বাসযোগ্য করতে গার্হস্থ্য বিষয়ের প্রয়োজনই ছিল
বেশি। এ কারণে আদম (আ.) এর বংশধরদের মাঝে ধর্ম নিয়ে তেমন কোনো সমস্যার
সৃষ্টি হয়নি। (সূরা বাকারা : ২১৩)। কিন্তু আদম (আ.) এর মৃত্যুর পর কালের
বিবর্তনে মানুষের মধ্যে শিরকের অনুপ্রবেশ ঘটে। তার পরলোকগমনের হাজার বছর পর
হজরত নুহ (আ.) এর সম্প্রদায় ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসরা নামের
কয়েকজন মৃত নেককার লোকের পূজা শুরু করে। তাদের পূজায় লিপ্ত হওয়ার ধাপগুলো
এমন- মুহাম্মাদ ইবনে কায়েস বলেন, ওয়াদ ছিলেন নুহ পূর্বকালীন সময়ের সবচেয়ে
নেককার ও বুজুর্গ ব্যক্তি। লোকরা তাকে খুবই ভালোবাসত ও সম্মান করত। সে মারা
যাওয়ায় লোকরা খুব কষ্ট পেল এবং তার কবরের পাশে জড়ো হয়ে আহাজারি করতে লাগল।
ইবলিস শয়তান তাদের এ অবস্থা দেখে এক ফন্দি অাঁটল। সে মানুষের আকৃতি ধরে
এসে বলল, এ লোকের জন্য তোমাদের কী বেদনা তা আমি লক্ষ করেছি। আমি কি তোমাদের
তার এমন একটি প্রতিকৃতি বানিয়ে দেব যা তোমরা তোমাদের মিলন কেন্দ্রগুলোতে
রেখে দেবে এবং এর মাধ্যমে তোমরা তার কথা স্মরণ করবে? এসব নেককার মানুষের
মূর্তি সামনে থাকলে তাদের দেখে আল্লাহর প্রতি ইবাদতে অধিক আগ্রহ সৃষ্টি
হবে।
লোকরা তার কথায় খুশি হয়ে তাকে তার প্রতিকৃতি বানিয়ে দিতে বলল, যাতে তারা
তাকে চোখের সামনে দেখে তার জন্য শোক করতে পারে, তাকে স্মরণ করতে পারে।
এভাবে শয়তান তাদের জন্য ওয়াদ, সুওয়া, ইয়াগুছ, ইয়াউক ও নাসরা নামের
পুণ্যব্যক্তিদের প্রতিকৃতি বানিয়ে দেয় এবং লোকজন তাদের প্রতিকৃতি সামনে
রেখে তাকে স্মরণ করতে থাকে। ধীরে ধীরে অনেকে তাদের অসিলা বানিয়ে আখেরাতে
মুক্তি পাওয়ার আশায় তাদের পূজা শুরু করে। এ পূজা তাদের কবরেও হতে পারে,
কিংবা তাদের মূর্তি বানিয়েও হতে পারে। তাফসিরবিদরা দুইটি সম্ভাবনার কথাই
বলেছেন। কালক্রমে তাদের সন্তানরা তাদের এসব কাজ দেখতে লাগল। ধীরে ধীরে
বংশবৃদ্ধি হতে লাগল। নতুন প্রজন্ম ধীরে ধীরে ওই মূর্তি তৈরির আসল
উদ্দেশ্যটিই ভুলে গেল। তারা মৃত পুণ্যবান লোকটিকে নয়, এ মূর্তিকেই শ্রদ্ধা
করতে লাগল এবং মূর্তিকে বিভিন্ন ক্ষমতার অধিকারী মনে করে এটার পূজা করতে
লাগল। আর এভাবেই মানব ইতিহাসে সর্বপ্রথম মূর্তিপূজার সূচনা হলো।
এ পাঁচটি মূর্তির মাহাত্ম্য ও তাদের প্রতি ভক্তি লোকদের হৃদয়ে এমনভাবে
প্রোথিত হয়েছিল যে, তারা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এবং পারস্পরিক চুক্তি
সম্পাদনকালে তাদের নাম উল্লেখ করত। সম্প্রদায়ের এরূপ পতন দশায় আল্লাহ
তাদের হেদায়েতের জন্য নুহ (আ.) কে রাসুল হিসেবে পাঠান। (সূরা আরাফ : ৬১,
তাফসির ইবনে কাসির, বোখারি)। আরবের ইতিহাসে দেখা যায়, এ মূর্তিগুলোর পূজা
পরবর্তীকালে আরবদের মধ্যেও চালু ছিল। 'ওয়াদ' ছিল বনু কালবের জন্য দুমাতুল
জান্দালে, সুওয়া ছিল বনু হোজায়েলের জন্য, ইয়াগুছ ছিল বনু গুত্বায়েফের জন্য
জুরুফ নামক স্থানে, ইয়াউক ছিল বনু হামদানের জন্য এবং নাসরা ছিল হিমইয়ার
গোত্রের বনু জি-কালা'র জন্য।
পৃথিবীর প্রাচীনতম শিরক হলো নেককার মানুষের কবর অথবা তাদের মূর্তিপূজা, যা
আজও প্রায় সব ধর্মীয় সমাজে চালু আছে এবং বর্তমানে যা মুসলিম সমাজে
স্থানপূজা, কবরপূজা, ছবি-প্রতিকৃতি, মিনার ও ভাস্কর্য পূজায় রূপ নিয়েছে। এ
ভ্রান্ত বিশ্বাসের সবচে বড় উদাহরণ যিশুর মূর্তি। আজকের খ্রিস্টানরা গির্জায়
স্থাপিত যিশুর মূর্তির সামনে গিয়েই নতজানু হয়, তার কাছেই কায়মনে প্রার্থনা
করে, কোনো কিছু কামনা করে। তারা জানে যে এ মূর্তির কোনো কার্যক্ষমতা নেই
তবু তারা এটিকে নবির একটি সেম্বল বানিয়ে, ঈশ্বরের পুত্রের একটি উপমা বানিয়ে
তার পূজা করছে।
সূত্র : তাফসিরে ইবনে কাসির, কাসাসুল কুরআন, নবীদের কাহিনী
সালাহউদ্দিন জাহাঙ্গীর
সৌজন্যে : দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ
No comments:
Post a Comment