Saturday, June 11, 2016

ঈদ: সংজ্ঞা, প্রচলন ও হুকুম আহকাম

 

ঈদ অর্থ কী?


ঈদ অর্থ আনন্দ। এর শাব্দিক অর্থ হলো ‘বারবার ফিরে আসা’ (عَادَ-يَعُوْدُ-عِيْدًا) এ দিনটি বারবার ফিরে আসে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঈদ। আল্লাহ তা‘আলা এদিনে তার বান্দাকে নি‘আমাত ও অনুগ্রহ দ্বারা বারবার ধন্য করে থাকেন, বারবার ইহসান করেন। রমযানের পানাহার নিষিদ্ধ করার পর আবার পানাহারের আদেশ প্রদান করেন। ফিত্‌রা প্রদান ও গ্রহণ, হজ পালন ও কুরবানীর গোশত ভক্ষণ ইত্যাদি নি‘আমাত বছর ঘুরিয়ে তিনি বারবার বান্দাদেরকে ফিরিয়ে দেন। এতে মানুষের প্রাণে আনন্দের সঞ্চার হয়। এসব কারণে এ দিবসের নামকরণ হয়েছে ঈদ।


ঈদ কোন হিজরীতে শুরু হয়?


প্রথম হিজরীতেই ঈদ শুরু হয়। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র আগের নাবীদের সময় ঈদের প্রচলন ছিল না।


ঈদের প্রচলন কীভাবে শুরু হয়?


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন মাক্কা থেকে মাদ্বীনায় হিজরত করলেন তখন মাদ্বীনাবাসীদের মধ্যে বিশেষ দু’টি দিবস ছিল, সে দিবসে তারা খেলাধুলা করত। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন এ দু’টি দিনের তাৎপর্য কী? মাদ্বীনাবাসীরা উত্তর দিল আমরা জাহেলী যুগ থেকে এ দু’দিনে খেলাধুলা করে আসছি। তখন রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
قَدْ أَبْدَلَكُمُ اللهُ خَيْرًا مِنْهُمَا يَوْمُ الأَضَحٰى وَيَوْمُ الْفِطْرِ
আল্লাহ রাববুল ‘আলামীন এ দু’দিনের পরিবর্তে এর চেয়েও উত্তম দু’টি দিন তোমাদেরকে দান করেছেন। আর সেই দিন দু’টি হল : ঈদুল আযহা ও ঈদুল ফিতর। (আবূ দাউদ : ১১৩৪; নাসাঈ : ১৫৫৬)


ঈদের সালাতের হুকুম কী?


ইমাম আবূ হানীফা (রহ.) বলেছেন, ঈদের সালাত প্রত্যেক ব্যক্তির উপর ওয়াজিব। ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ একই মত পোষণ করেন।


ঈদের সালাতের আগে আমাদের করণীয় কী কী?


নিম্নবর্ণিত কাজগুলো করা সুন্নাত/মুস্তাহাব।
১. গোসল করা, পরিষ্কার পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব।
২. ঈদুল ফিতরের দিন খাবার খেয়ে ঈদের সালাতে যাওয়া, আর ঈদুল আযহার দিন না খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নাত। তাছাড়া ঈদুল আযহার সালাত শেষে কুরবানীর গোশত দিয়ে খাবার গ্রহণ করা সুন্নাত।
৩. ঈদগাহে পায়ে হেটে যাওয়া মুস্তাহাব। আর একপথে যাবে এবং ভিন্ন পথ দিয়ে আবার পায়ে হেটেই আসা সুন্নাত।
৪. তাকবীর পড়া এবং তা বেশি বেশি ও উচ্চস্বরে পড়া সুন্নাত। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘর থেকে ঈদগাহ পর্যন্ত তাকবীর দিতে দিতে যেতেন। [১]
উল্লেখ্য যে, ফজরের সালাতের পর ঈদের সালাতের পূর্বে অন্য কোন নফল সালাত নেই।
ফুটনোটঃ[১] ঈদগাহের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে তাকবীর পাঠ শুরু করবে এবং ইমাম সাহেব সালাত শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতে থাকবে।

ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের তাকবীর শুরু করবে ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকেই। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর পাঠ করতেন।
 

ঈদের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী ধরনের পোশাক পরতেন?


আল্লামা ইবনু কাইয়িম (রহ.) তার সুপ্রসিদ্ধ গ্রন্থ যাদুল মা‘আদে লিখেছেন, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদের দিন উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। তাঁর এক জোড়া পোশাক ছিল যা দু’ ঈদ ও জুমু‘আর দিন পরিধান করতেন। অন্য এক হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إِنَّ اللهَ تَعَالٰى يُحِبُّ أَنْ يَرى أَثَرَ نِعْمَتِهِ عَلٰى عَبْدِهِ
আল্লাহ রাববুল আলামীন তার বান্দার উপর তার প্রদত্ত নি‘আমাতের প্রকাশ দেখতে পছন্দ করেন। (তিরমিযী : ২৮১৯)


কোন পুরুষ লোক যদি রেশমী কাপড় পরে তাহলে এর হুকুম কি?


পুরুষদের জন্য রেশমী কাপড় পরা হারাম। আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত। উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার বাজার থেকে একটি রেশমী কাপড়ের জুব্বা নিয়ে এলেন এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তা দিয়ে বললেন : (হে আল্লাহর রাসূল) আপনি এটি কিনে নিন। ঈদের সময় ও আগত গণ্যমান্য অতিথিদের সাথে সাক্ষাতের সময় এটা পরিধান করবেন। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
إِنَّمَا هٰذِهِ لِبَاسٌ مَنْ لاَخَلاَقَ لَهُ
‘এটা ঐ ব্যক্তির পোশাক যে আখিরাতে আল্লাহর কাছে কিছুই পাবে না।’ তাছাড়া বর্তমান সিল্ক হিসেবে যেসব কাপড় পাওয়া যায় সেগুলোও রেশমী কাপড়। (বুখারী : ৯৪৮)


ঈদের দিন খাবার গ্রহণ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সুন্নাত কী ছিল?


১. নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের দিন না খেয়ে ঘরে থেকে বের হতেন না। আর ঈদুল আযহার দিন ঈদের সালাত আদায় না করে কোন কিছু খেতেন না।
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- لاَ يَغْدُوْ يَوْمَ الْفِطْرِ حَتّٰى يَأْكُلَ تَمَرَاتٍ
২. ঈদুল ফিতরের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খেজুর না খেয়ে ঈদগাহে রওয়ানা হতেন না। আনাস বলেন, আর খেজুর খেতেন বেজোড় সংখ্যায় (অর্থাৎ তিনটি, পাঁচটি বা সাতটি এভাবে)। (বুখারী : ৯৫৩)
 

ঈদগাহে কখন যাওয়া উত্তম?


ঈদগাহে তাড়াতাড়ি যাওয়া উচিৎ যাতে ইমাম সাহেবের কাছাকাছি বসা যায়, প্রথম কাতারে সালাত আদায় করা যায়। তাছাড়া সালাতের জন্য অপেক্ষা করা এসব অতীব সওয়াবের কাজ।


ঈদের সালাতে যাওয়া-আসায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দু’টি পথ ব্যবহার করতেন। একপথে যেতেন, ভিন্ন আর এক পথে বাড়ী ফিরতেন। এর হিকমত কী?


উলামায়ে কিরাম এ বিষয়ে বিভিন্ন হিকমাত বর্ণনা করেছেন। এর মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন :
১. পথ ভিন্ন ভিন্ন হলে উভয় পথের লোকদের সালাম দেয়া যায় এবং ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়।
২. মুসলিমদের অবস্থা ও শান শওকত পর্যবেক্ষণ করতে পারা যায়।
৩. গাছপালা তরুলতা ও মাটি মুসল্লীদের পক্ষে স্বাক্ষী হয়ে থাকতে পারে।


ঈদের দিন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তাকবীর পড়তে পড়তে যেতেন সেটি কোন তাকবীর?


তাকবীরটি হল :
اَللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ لاَ إِلَهَ إِلاَّ اللهُ
اَللهُ أَكْبَرُ اللهُ أَكْبَرُ وَللهِ الْحَمْدُ
উচ্চারণ : আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। আল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার ওয়া লিল্লাহিল হামদ।
অর্থ : আল্লাহ মহান, আল্লাহ অতিমহান, তিনি ছাড়া সত্যিকার আর কোন মা‘বুদ নেই। আল্লাহ মহান আল্লাহ মহান আর সমস্ত প্রশংসা শুধুমাত্র তাঁরই জন্য।


তাকবীর কীভাবে পড়ব?


তাকবীর প্রকাশ্যে ও উচ্চস্বরে পড়া সুন্নাত। আর তা বেশি বেশি পড়াও সুন্নাত।


তাকবীর পাঠ কখন শুরু ও শেষ করব?


ঈদগাহের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে তাকবীর পাঠ শুরু করবে এবং ইমাম সাহেব সালাত শুরু করার পূর্ব পর্যন্ত তাকবীর পাঠ করতে থাকবে।
ইমাম ইবনে তাইমিয়্যাহ (রহঃ) বলেছেন, ঈদুল ফিতরের তাকবীর শুরু করবে ঈদের চাঁদ উদিত হওয়ার পর থেকেই। ঈদের সালাত শেষ হওয়া পর্যন্ত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর পাঠ করতেন।


মেয়েদের কি ঈদের সালাতে যাওয়া জায়েয আছে?


হ্যা, অবশ্যই। উলামায়ে কিরাম এটাকে জরুরী বলেছেন। তারা যাবে।
পাঁচওয়াক্ত সালাত ও জুমু‘আর জামাতে শরীক হওয়ার জন্য মেয়েদেরকে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অনুমতি দিয়েছেন। আর ঈদের সালাতের যাওয়ার জন্য তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। হাদীসে আছে যে,
عَنْ أُمِّ عَطِيَّةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا قَالَتْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- أَنْ نُخْرِجَ فِي الْفِطْرِ وَالأَضْحَى الْعَوَائِقَ وَالْحَيْضَ وَذَوَاتِ الْخُدُرِ فَأَمَّا الْحَيْض فَيَعْتَزِلن الصَّلاَةَ وَيَشْهَدْنَ الْخَيْرَ وَدَعْوَةِ الْمُسْلِمِيْنَ قَالَتْ يَارَسُوْلَ اللهِ إِحْدَانَا لاَ يَكُوْنُ لَهَا حِلْبَابَ قَالَ لتلبسَهَا أُخْتِهَا
‘‘উম্মে আতীয়াহ থেকে বর্ণিত হয়েছে, তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের এ মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে, আমরা যেন পরিণত বয়স্কা, ঋতুবতী ও গৃহিনীসহ সকল মহিলাকে ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাতে শরীক হওয়ার জন্য ঘর থেকে বের করে নিয়ে যাই। এমনকি মাসিক হায়েয চলাকালীন মেয়েরাও (ঈদগাহে হাজির হবে। তবে তারা) সালাত আদায় থেকে বিরত থাকবে। কিন্তু ঈদের কল্যাণকর অবস্থা তারা প্রত্যক্ষ করবে এবং মুসলিমদের সাথে দু‘আয় ঋতুবতী মহিলারাও শরীক হবে।
উম্মে আতীয়াহ  বললেন, হে আল্লাহর রাসূল, আমাদের মধ্যে কারো কারো উড়না নেই (বড় চাদর নাই যা পরিধান করে ঈদগাহে যেতে পারে)। উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, যার ওড়না নেই সে তার অন্য বোন থেকে (ধার করে) ওড়না নিয়ে তা পরিধান করে ঈদগাহে যাবে। (মুসলিম : ৮৯০)
বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বর্ণিত এ হাদীসে যে ঋতুবতী মহিলার উপর সালাত আদায় ফরজ নয় তাকেও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদগাহে যেতে নির্দেশ দিয়েছেন এবং যার উড়না নেই তাকেও একটা উড়না ধার করে নিয়ে ঈদের সালাতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
এ হাদীস দ্বারা অনেক বিজ্ঞ উলামায়ে কিরাম মেয়েদের ঈদের সালাতে যাওয়া ওয়াজিব বলেছেন।
 যেসব লোক একথা বলেন যে, বর্তমান যুগ ফিতনার যুগ, মেয়েদের নিরাপত্তা নেই এসব কথা বলে মেয়েদেরকে ঈদের সালাত থেকে বঞ্চিত রাখছেন। তাদের এ অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়।
তারা যেন প্রকারান্তরে এ হাদীসের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। শেষ যামানার ফিতনা বাড়বে একথা নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের চেয়ে বেশি অবগত থাকার পরও মহিলাদেরকে ঈদের সালাতে যেতে হুকুম দিয়েছেন। আর এ হুকুম সুন্নাত নয়, বরং ওয়াজিব।
মেয়েরা ঈদের সালাতে গেলে পথিমধ্যে তাকবীর বলা, সালাতে শরীক হওয়া, বয়ান ও ওয়াজ নসীহত শোনার সৌভাগ্য তাদের হয়ে থাকে। কাজেই ক্ষতির যে আশংকা করা হয় এর চেয়ে তাদের উপকারের দিকই বেশি।
তাই সম্মানিত ঈদগাহ কর্তৃপক্ষের উচিৎ তারা যেন মেয়েদের জন্য পৃথক প্যান্ডেল তৈরীকরে দেন আর মেয়েরাও যেন সম্পূর্ণ শরয়ী পর্দা করে অত্যন্ত শালীনভাবে পথ চলেন, ঈদগাহে যাওয়া আসা করেন। কাউকে ডিস্টার্ব না করেন। আল্লাহ আমাদের সকলকে সহীহ হাদীস আমল করার ও হক পথে থাকার তাওফীক দান করুন- আমীন!


ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা- এর কোনটি আওয়াল ওয়াক্তে (অর্থাৎ প্রথম ওয়াক্তে) পড়ব?


ইবনুল কায়্যিম (রহ.) বলেছেন,
নাবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের সালাত একটু দেরী করে আদায় করতেন। আর ঈদুল আযহার সালাত প্রথম ওয়াক্তে তাড়াতাড়ি আদায় করতেন। (যাদুল মা‘আদ)
এ বিষয়ক সকল হাদীস বিশ্লেষণ করলে পরিষ্কার বুঝা যায় যে, সূর্যোদয়ের পর থেকে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ঈদুল আযহা এবং আড়াই ঘণ্টার মধ্যে ঈদুল ফিতর পড়া উত্তম।


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতরের সালাত ঈদুল আযহার সালাতের চেয়ে একটু দেরী করে পড়তেন কেন?


তুলনামূলক ভাবে ঈদুল ফিতরের সালাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একটু দেরী করে পড়তেন এ কারণে যাতে লোকেরা সাদাকাতুল ফিতর (অর্থাৎ ফিত্‌রা) প্রদানের প্রয়োজনীয় কাজগুলো সেরে নিয়ে ঈদগাহে যেতে পারে।
আর ঈদুল আযহা তাড়াতাড়ি প্রথম ওয়াক্তে আদায় করতেন যাতে করে সালাত শেষ করে কুরবানীর পশু জবাইয়ের কাজ সম্পন্ন করতে পারে।


ঈদের সালাত কোথায় আদায় করা সুন্নাত?


কোন একটা মাঠে ঈদের সালাত আদায় করা সুন্নাত।


নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোথায় ঈদের সালাত আদায় করতেন?


যাদুল মা‘আদ কিতাবে ইবনুল কায়্যিম (রহ.) লিখেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আজীবন ঈদের সালাত ঈদগাহে আদায় করেছেন।
হাদীসে আছে যে,
عَنْ أَبِيْ سَعِيْدٍ الْخُدْرِيِّ قَالَ كَانَ رَسُوْلُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- يَخْرُجُ يَوْمَ الْفِطْرِ وَالأَضْحَى إِلَى الْمُصَلَّى
আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাত আদায়ের জন্য ঈদগাহে যেতেন। (বুখারী : ৯৫৬)


বৃষ্টি, ঝড়-তুফান ও নিরাপত্তহীনতা ইত্যাদি অবস্থায় মাসজিদে ঈদের সালাত আদায় করা কি জায়েয হবে?


হা, জায়েয আছে।
আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একবার বৃষ্টি হওয়ায় নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সবাইকে নিয়ে মাসজিদে ঈদের সালাত আদায় করেছিলেন। (আবূ দাউদ, ইবনে মাজাহ মিশকাত)
(অবশ্য নাসিরুদ্দ্বীন আলবানী (রহ.) এটাকে দুর্বল হাদীস বলেছেন)


ঈদের সালাতে কোন আযান ও ইকামাত নেই এ বিষয়ে দলীল আছে কি?


হাঁ, দলীল আছে।
(১) ইবনে আব্বাস ও জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তারা বলেন,
لَمْ يَكُنْ يُؤَذِّنْ يَوْمَ الْفِطْرِ وَيَوْمَ الأَضْحٰى
(রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র যামানায়) ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাতে আযান দেয়া হতো না। (বুখারী : ৯৬০)
(২) জাবের ইবনে সামুরা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
صَلَّيْتُ مَعَ رَسُوْلِ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- الْعِيْدَيْنِ غَيْرَ مَرَّةٍ وَلاَ مَرَّتَيْنِ بِغَيْرِ آذَانٍ وَلاَ إِقَامَةٍ
আমি বহুবার রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সাথে দু’ ঈদের সালাত আদায় করেছি কোন আযান ও ইকামাত ছাড়াই। (মুসলিম : ৮৮৭)


ঈদের সালাত কত রাকআত?


দুই রাকা‘আত।
উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
صَلاَةُ الْجُمُعَةِ رَكْعَتَانِ وَصَلاَةُ الْفِطْرِ رَكْعَتَانِ وَصَلاَةُ الأَضْحَى رَكْعَتَانِ وَصَلاَةُ السَّفَرِ رَكْعَتَانِ
জুমু‘আর সালাত দু’ রাক‘আত, ঈদুল ফিতরের সালাত দু’ রাক‘আত, ঈদুল আজহার সালাত দু’ রাক‘আত এবং সফর অবস্থায় (চার রাক‘আত বিশিষ্ট ফরয) সালাত দুই রাক‘আত। (নাসাঈ : ১৪২০)


এ দু’ রাক‘আত ঈদের সালাতের আগে পরে কি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন নফল সুন্নাত সালাত পড়তেন?


না, ঈদের সালাতের সাথে এর আগে পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোন নফল সুন্নাত সালাত আদায় করেননি। (মুসনাদে আহমাদ)


ঈদের সালাতে দাঁড়িয়ে তাকবীরে তাহরীমা বাধার পর ‘‘আল্লাহু আকবার বলে অতিরিক্ত যে কিছু তাকবীর দেয়া হয় এর মোট সংখ্যা কত?


এ বিষয়ে প্রধানতঃ দু’টি মত রয়েছে :
ক. ১ম ও ২য় রাক‘আতে অতিরিক্ত ৩ + ৩ = মোট ৬ তাকবীর। এটি হানাফী মাযহাবের ইমাম আবূ হানিফার (রহ.) মত।
(খ) দ্বিতীয় মত হল :
১ম ও ২য় রাক‘আতে যথাক্রমে অতিরিক্ত ৭ + ৫ = মোট ১২ তাকবীর। এটি বাকী ৩ মাযহাবের মত।


যারা অতিরিক্ত ৬ তাকবীরে ঈদের সালাত আদায় করেন তাদের দলীল কি?


ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি রেওয়ায়েতে ৪ তাকবীরে ঈদের নামাযের স্বপক্ষে একটি হাদীস পাওয়া যায়। একদল ফকীহ এ ৪ তাকবীরকে প্রথম রাকাতে তাকবীরে উলার সাথে ৩ তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকাতে রুকুর তাকবীর সহ ৩ তাকবীর-এভাবে অতিরিক্ত ৬ তাকবীরের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মুহাদ্দিস আল্লামা নাসিরুদ্দ্বীন আলবানী (রহঃ) এটাকে দুর্বল হাদীস বলেছেন।


প্রথম রাকআতে অতিরিক্ত ৭ এবং দ্বিতীয় রাকআতে অতিরিক্ত ৫ তাকবীরে (অর্থাৎ অতিরিক্ত মোট ১২ তাকবীরে) যারা ঈদের সালাত আদায় করে থাকেন তাদের দলীল কি?


(১) আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন যে,
أَنَّ رَسُوْلَ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- كَانَ يُكَبِّرُ فِي الْفِطْرِ وَالأضْحٰى فِي الأُوْلٰى سَبْعَ تَكْبِيْرَات وَفِيْ الثَّانِيَةِ خَمْسًا
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাতে ১ম রাকআতে (অতিরিক্ত) ৭টি তাকবীর ও ২য় রাকআতে (অতিরিক্ত) ৫টি তাকবীর পাঠ করতেন। (আবূ দাউদ : ১০১৮)
[২] হাদীসে আরো এসেছে :
ابنُ عباس كَبَّرَ فِي العِيْدِ اثْنَتَى عَشَرَةَ تَكْبِيْرَةً سَبْعًا فِي الأُوْلَى وَخَمْسًا فِي الآخِرَةِ
(প্রখ্যাত সাহাবী) ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহু ঈদের সালাতে অতিরিক্ত) ১২ তাকবীর বলেছেন। প্রথম রাকআতে ৭টি এবং দ্বিতীয় রাকআতে ৫টি। (বায়হাকী ৩/৪০৭)


অতিরিক্ত ৬ তাকবীর ও ১২ তাকবীরের মধ্যে দলীল হিসেবে কোনটি বেশি শক্তিশালী?


অধিকাংশ আলেম ১২ তাকবীরের মাসআলাকে বেশি শক্তিশালী বলেছেন। তাছাড়া এ মাসআলার উপর আমল করেছেন একই মাযহাবের ইমাম আবূ হানীফার অনুসারী তার দুই ছাত্র ইমাম আবূ ইউসুফ (রহ.) ও ইমাম মুহাম্মাদ (রহ.)। মালিকী, শাফিঈ‘, হাম্বলী মাযহাব ও আহলে হাদীসের লোকেরা এবং মাক্কা ও মাদ্বীনার ইমামগণ এভাবে অতিরিক্ত ১২ তাকবীরে ঈদের সালাত আদায় করে থাকেন। (রাদ্দুল মুহতার ৬৬৪ পৃঃ)


আমরা যারা হানাফী মাযহাবের অনুসারী তারা কি অতিরিক্ত ১২ তাকবীরের মাসআলাটি আমল করতে পারি?


হ্যাঁ, তা আমল করা জায়েয আছে। বিখ্যাত হানাফী মাযহাবের সম্মানিত ইমাম আবু হানীফা (র.) বলেছেন, কোন মাসআলায় সহীহ হাদীস পাওয়া গেলে তাঁর অনুসারীরা তা আমল করতে পারবে। সে ক্ষেত্রে এটাও তাঁরই মাযহাবের অন্তর্ভুক্ত বলে গণ্য হবে। তিনি বলেছেন :
إذا صَحَّ الْحَدِيْثُ فَهُوَ مَذْهَبِيْ
‘‘ছহীহ হাদীস পাওয়া গেলে সেটাই আমার মাযহাব বলে গণ্য হবে।’’


আল্লাহু আকবার বলে যে অতিরিক্ত তাকবীর দেয়া হয় এর হুকুম কি?


হানাফী ও মালেকী মাযহাবে বাড়তি তাকবীর বলা ওয়াজিব। এটা ছুটে গেলে সাহু সিজদা দিতে হবে।
পক্ষান্তরে অন্যান্য মাযহাবে বাড়তি তাকবীর বলা সুন্নাত।


বাড়তি তাকবীর বলার সময় প্রত্যেক তাকবীরেই কি হাত উঠাতে হবে?


হ্যাঁ। দ্বিতীয় খলীফা উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু জানাযা ও ঈদের সালাতে প্রত্যেক তাকবীরে দু’হাত তুলতেন। (বায়হাকী)


প্রত্যেক তাকবীর বলার সময় কোন পর্যন্ত হাত তুলতে হয়?


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর বলার সয়ম দু’ হাত তাঁর কাঁধ বা কান পর্যন্ত তুলতেন।


অতিরিক্ত তাকবীরগুলো কখন বলতে হয়?


এ প্রশ্নেও মতবিরোধ রয়েছে।
[ক] প্রথম মত ৬ তাকবীরের মাসআলা :
সালাতে দাড়িয়ে নিয়ত করে তাকবীরের তাহরীমা বাঁধার পর অতিরিক্ত আরো ৩ তাকবীর দিবে এবং ২য় রাক‘আতে কিরা‘আত শেষ হলে রুকুর পূর্বে বাড়তি আরো ৩ তাকবীর দেবে। অবশেষে ৪র্থ তাকবীর দিয়ে রুকুতে চলে যাবে।
[খ] দ্বিতীয় মত ১২ তাকবীরের মাসআলা :
প্রথম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমা (আল্লাহু আকবার) বলার পর অতিরিক্ত আরো ৭ বার তাকবীর বলবে এবং দ্বিতীয় রাক‘আতের শুরুতেও সূরা ফাতেহা পড়ার আগেই অতিরিক্ত আরো ৫ বার তাকবীর বলবে।
সাহাবী আবদুল্লাহ ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
شَهِدْتُ الأَضْحَى وَالْفِطْرَ مَعَ أَبِيْ هُرَيْرَةَ فَكَبَّرَ فِي الرَّكْعَةِ الأُوْلَى سَبْعَ تَكْبِيْرَات قَبْلَ الْقِرَاءَةِ وَفِي الآخِرَةِ خَمْسَ تَكْبِيْرَاتٍ قَبْلَ الْقِرَاءَةِ
আমি ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহার সালাত (সাহাবী) আবূ হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু’র সাথে আদায় করেছি। তাতে তিনি প্রথম রাকাআতে কিরআত পাঠ (অর্থাৎ সূরা ফাতিহা শুরু) করার আগেই ৭ (সাত) তাকবীর এবং দ্বিতীয় রাকআতে (একই নিয়মে) কিরাআত পাঠ করার পূর্বেই ৫ (পাঁচ) তাকবীর বলতেন। (বায়হাকী : ৩/৪০৬)
ইমাম বায়হাকী বলেছেন, এটাই সুন্নাতী নিয়ম।


অতিরিক্ত তাকবীর বলার ক্ষেত্রে প্রতি দু’ তাকবীরের মাঝখানে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি কোন কিছু পড়তেন?


না, তখন তিনি চুপ থাকতেন।


অতিরিক্ত তাকবীর বলার সময় হাত বাঁধবে নাকি ছেড়ে দেবে?


হাত বেঁধে ফেলবেন।


শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কীভাবে ঈদের সালাত আদায় করব?


(ক) প্রথম নিয়ম :
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সময়ে ঈদগাহে যাওয়ার সময় একটি লাঠি বা বল্লম বয়ে নিয়ে যাওয়া হত এবং সালাত শুরুর আগেই সেটা তার সমনে ‘সুতরা’ হিসেবে মাটিতে গেড়ে দেয়া হত। (বুখারী পৃঃ ১৩৩)
অতঃপর তিনি (নিয়ত করে) ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তাকবীরে তাহরীমা বলে হাত বাঁধতেন। এরপর তিনি ‘সুবহানাকাল্লাহুম্মা.........’’ পড়তেন। (ইবনে খুযাইমা)
তারপর সূরা ফাতিহা পড়ার পূর্বেই তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একের পর এক মোট ৭ বার তাকবীর দিতেন (অর্থাৎ আল্লাহু আকবার বলতেন)। প্রতি দু’ তাকবীরের মাঝখানে তিনি একটুখানি চুপ থাকতেন। ইবনে উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র সুন্নাত অনুসরণের অধিক পাবন্দি হওয়ার কারণে প্রত্যেক তাকবীরের সাথে দু’ হাত তুলতেন এবং প্রত্যেক তাকবীরের পর আবার হাত বেঁধে ফেলতেন। (বায়হাকী)
এভাবে ৭টি তাকবীর বলার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহা পড়তেন। এরপর তিনি আরেকটি সুরা মিলিয়ে পড়তেন। এরপর তিনি রুকুও সিজদা করতেন।
এভাবে প্রথম রাক‘আত শেষ করার পর সাজদাহ থেকে উঠে (সূরা ফাতিহা শুরুর পূর্বেই) তিনি (২য় রাকাতে) পরপর ৫টি তাকবীর দিতেন। তারপর সূরা ফাতিহা পড়ে আরেকটি সূরা পড়তেন। এরপর তিনি রুকু ও সাজদাহ করে দু’ রাক‘আত ঈদের সালাত শেষ করতেন। সালাম ফিরানোর পর তিনি একটি তীরের উপর ভর দিয়ে যমীনে দাঁড়িয়ে খুৎবা দিতেন। তখন ঈদগাহে কোন মিম্বর নেয়া হত না। তারপর দু’আ করে শেষ করে দিতেন। (যাদুল মা‘আত ১ম খণ্ড)
(খ) দ্বিতীয় নিয়ম :
দ্বিতীয় নিয়মটি প্রথমটির মতই। শুধু পার্থক্য হল ১ম রাক‘আতে তাকবীরে তাহরীমার পর অতিরিক্ত ৩ তাকবীর বলবে এবং এর প্রথম দু’ তাকবীরে হাত ছেড়ে দেবে এবং শেষ তাকবীরে হাত বেঁধে ফেলবে।
আর দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা শেষে রুকুর পূর্বে অতিরিক্ত ৩ তাকবীর দেবে এবং প্রত্যেক তাকবীরেই হাত ছেড়ে দেবে। অতঃপর ৪র্থ তাকবীর বলে রুকুতে চলে যাবে। আর বাকী সব নিয়মকানুন একই।


সলাতুল ঈদে সূরা ফাতিহা পড়ার পর কোন সূরা পড়া মুসতাহাব?


প্রথম রাক‘আতে সূরা আলা এবং দ্বিতীয় রাকআতে সূরা গাশিয়াহ পড়া। অথবা প্রথম রাক‘আতে সূরা কাফ এবং দ্বিতীয় রাক‘আতে সূরা কামার পড়া। (মুসলিম : ৮৯১) এভাবে পড়া মুস্তাহাব। না পারলে যেকোন সূরা দিয়ে পড়া জায়েয আছে। এতে কোন ক্ষতি নেই।


ফিত্‌রা - যাকাত

ফিত্‌রা কী জিনিস?


রমযান মাসের সিয়ামের ত্রুটি বিচ্যুতির ক্ষতি পূরণার্থে এবং অভাবগ্রস্তদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে ঈদের সালাতের পূর্বে নির্ধারিত পরিমানের যে খাদ্য সামগ্রী দান করা হয়ে থাকে- শরীয়াতের পরিভাষায় তাকেই যাকাতুল ফিতর বা ফিত্‌রা বলা হয়ে থাকে।


ফিত্‌রা প্রদানের হুকুম কী?


ফিত্‌রা দেয়া ওয়াজিব।


কোন ব্যক্তির উপর ফিত্‌রা দেয়া ওয়াজিব?


প্রত্যেক মুসলিম নারী-পুরুষ, ছোট-বড়, স্বাধীন-পরাধীন, ধনী-গরীব সকলের উপর ফিত্‌রা দেয়া ওয়াজিব।


কী পরিমাণ সম্পদ থাকলে ফিতরা দেয়া ফরয হয়?


ঈদের দিন যদি কোন মুসলিম ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের প্রয়োজনীয় খাবারের চেয়ে অতিরিক্ত আরো ২ কেজি ৪০ গ্রাম পরিমাণ নির্দিষ্ট খাবার মওজুদ থাকে তাহলে ঐ ব্যক্তি ও তার পরিবারবর্গের সকল সদস্যদের উপর ফিত্‌রা প্রদান ফরয হয়ে যাবে।
(ক) আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্বাধীন, কৃতদাস, নারী, পুরুষ, ছোট, বড় প্রত্যেক মুসলিমের প্রতি রমাযানের সিয়ামের কারণে এক সা‘আ খেজুর বা এক সা‘আ যব ফিত্‌রা হিসেবে ফরয করে দিয়েছেন। (বুখারী : ১৫০৩; মুসলিম : ৯৮৪)
(খ) আহমাদের একটি বিশুদ্ধ হাদীসে আবূ হুরাইরাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত আছে যে,
فِيْ زَكَاةِ الْفِطْرِ عَلَى كُلِّ حَرٍّ وَعَبْدٍ ذَكَرٍ وَأُنْثَى صَغِيْرٍ أَوْ كَبِيْرٍ فَقِيْرٍ أَوْ غَنِىٍّ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ
প্রত্যেক স্বাধীন, পরাধীন, নারী, পুরুষ ছোট, বড়, ফকীর-ধনী, প্রত্যেকের উপর জনপ্রতি এক সা‘আ (২ কেজি ৪০ গ্রাম) পরিমাণ খেজুর ফিত্‌রা হিসেবে দান করা ওয়াজিব।
তবে ইমাম আবূ হানীফার (রহ.) মতে ঈদের দিন যাকাতের নেসাব পরিমাণ সম্পদ থাকলে অর্থাৎ ঐদিন ভোরে প্রয়োজনের অতিরিক্ত হিসেবে যার ঘরে সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা বায়ান্ন তোলা রৌপ্য বা এর সমপরিমাণ নগদ অর্থ থাকবে শুধু ঐ পরিবারের উপর ফিত্‌রা দেয়া ফরয হবে।


যে দরিদ্র ব্যক্তি ফিত্‌রা গ্রহণ করবে সেও কি তার নিজের ও পরিবারের সদস্যদের ফিত্‌রা প্রদান করবে?


না, দিবে না।


ফিত্‌রা কাকে দিব?


যারা যাকাত খেতে পারে তাদেরকেই ফিত্‌রা দেবেন।


একাধিক লোকের ফিত্‌রা কি একজন দরিদ্রকে দেয়া জায়েয?


হা, তা জায়েয। অপরদিকে এক ব্যক্তির ফিত্‌রা ভাগ করে একাধিক লোককে দেয়াও জায়েয আছে।


ফিত্‌রা হিসেবে কী ধরনের খাদ্যদ্রব্য দেয়ার বিধান আছে?


গম, ভুট্টা, যব, খেজুর, কিসমিস, পনির, আটা, চাউল ইত্যাদি খাদ্যদ্রব্য।


প্রতি একজনের উপর কী পরিমাণ ফিত্‌রা দেয়া ফরয?


এক সা‘আ পরিমাণ। আলেমদের মতে সা‘আর সমপরিমাণ হল ২ কেজি ৪০ গ্রাম।
(ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাহাবী আবূ সাঈদ খুদরী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন,
كُنَّا نُخْرِجُ زَكَاةَ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ أَوْ صَاعًا مِنْ شَعِيْرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ تَمَرٍ أَوْ صَاعًا مِنْ أقط أَوْ صَاعًا مِنْ زَبِيْبٍ
‘আমরা ফিত্‌রা দিতাম মাথাপিছু এক সা‘আ পরিমাণ খাদ্য বা এক সা‘আ যব বা এক সা‘আ খেজুর বা এক সা‘আ পনির বা এক সা‘আ কিসমিস’। (বুখারী : ১৫০৬; মুসলিম : ৯৮৫)
(খ) নাসাঈর অন্য এক হাদীসে আছে
صَدَقَةُ الْفِطْرِ صَاعًا مِنْ طَعَامٍ
ফিত্‌রা হচ্ছে এক সা‘আ পরিমাণ খাদ্যবস্তু।
এ মাসআলাটি মতবিরোধপূর্ণ। ইমাম আবূ হানিফা (রহ.) বলেছেন, ফিতরার পরিমাণ অর্ধেক সা‘ অর্থাৎ ১ কেজি ২০ গ্রাম খাদ্যদ্রব্য। উলামায়ে কিরাম অনেক যাচাই বাছাই করে দেখেছেন যে, অর্ধেক সা‘ এর পক্ষের অধিকাংশ হাদীসই দুর্বল। সে কারণে সক্ষম ব্যক্তিদের এক সা‘ পরিমাণ ফিত্‌রা প্রদান করাই আমি (লেখক) উত্তম মনে করছি।


খাদ্যদ্রব্য না দিয়ে এর বদলে টাকা পয়সা দিয়ে কি ফিত্‌রা দেয়া জায়েয হবে?


মালিকী, শাফেয়ী ও হাম্বালী এ তিন মাযহাবের ইমামগণ বলেছেন, যেহেতু হাদীসে খাদ্যদ্রব্য দান করতে বলা হয়েছে সেহেতু টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্‌রা দিলে তা জায়েয হবে না। কিন্তু কিয়াসের আলোকে হানাফী মাযহাবে টাকা পয়সা দিয়ে ফিত্‌রা দেয়াকে জায়েয বলেছেন। বিবেকের বিশ্লষণে আপনি যে কোন একটা মত গ্রহণ করতে পারেন।


ফিত্‌রা কোন সময় প্রদান করব?


ফিত্‌রা দেয়ার দু’টি সময় আছে : একটি হল উত্তম সময়, অন্যটি হল বৈধ সময়। উত্তম সময় হল ঈদের দিন ঈদের সালাত আদায় করার পূর্বে ফিত্‌রা প্রদান শেষ করা। আর জায়েয সময় হল ঈদের দু’এক দিন আগেই ফিত্‌রা প্রদান করে ফেলা। ইবনু ‘উমার বলেছেন,
أَنَّ النَّبْيَّ -صلى الله عليه وسلم- أَمَرَ بِزَكَاةِ الْفِطْرِ قَبْلَ خُرُوْجِ النَّاسِ إِلَى الصَّلاَةِ
নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদের ঈদের সালাত আদায় করার আগেই ফিত্‌রা দিয়ে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। (বুখারী : ১৫০৯; মুসলিম : ৯৮৬)


ফিত্‌রা প্রদানের ফরয সময় কখন শুরু হয়?


ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।


যদি কোন ব্যক্তি ঈদের সালাত আদায়ের পর ফিত্‌রা প্রদান করে তাহলে কি তা আদায় হবে?


সালাত আদায়ের পূর্বে হলে তা ফিৎরা হিসেবে গণ্য হবে। আর সালাতের পর হলে তা হবে সাধারণ দান। আবদুল্লাহ ইবনু আব্বাস বর্ণিত হাদীসে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
زَكَاةُ الْفِطْرِ طُهْرَةٌ لِلصَّائِمِ مِنَ اللَّغْوِ وَالرَّفَثِ وَطَعْمِهِ لِلْمَسَاكِيْنَ - فَمَنْ أَدَّاهَا قَبْلَ الصَّلاَةِ فَهِيَ زَكَاةٌ مَقْبُوْلَةٌ وَمَنْ أَدَّاهَا بَعْدَ الصَّلاَةِ فَهِيَ صَدَقَةٌ مِنْ صَدَقَاتٍ
সিয়াম পালনকারীর অপ্রয়োজনীয় ও বেফাস কথাবার্তা থেকে তাকে পবিত্রকরণ এবং গরীব মিসকীনদের খাবার প্রদানের উদ্দেশ্যে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফিত্‌রা প্রদান করাকে ফরয করে দিয়েছেন। অতএব যে ব্যক্তি ঈদের সালাতের আগে তা পরিশোধ করবে সেটা ফিত্‌রা হিসেবে আল্লাহর কাছে গৃহীত হবে। আর ঈদের সালাতের পর দিলে তা হবে একটা সাধারণ দান খয়রাত। (অর্থাৎ তা ফিত্‌রা হিসেবে গণ্য হবে না)। (আবূ দাউদ : ১৬০৯; ইবনে মাজাহ : ১৮২৭)


ঈদের দিন সূর্যোদয়ের আগে কোন শিশু জন্ম গ্রহণ করলে তার কি কোন ফিত্‌রা দেয়া লাগবে?


হা, লাগবে। তবে সেদিন সূর্যোদয়ের পর ভূমিষ্ট হলে ফিত্‌রা দেয়া লাগবে না। তবে দিয়ে দিলে সাওয়াব হবে। অনুরূপভাবে ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পূর্বে কেউ ইন্তেকাল করলে তার ফিত্‌রা দিতে হবে না। কিন্তু সেদিন সূর্যাস্তের পর মারা গেলে তার পক্ষে ফিত্‌রা দিতে হবে। কারণ ফিত্‌রা প্রদানের ফরয সময় শুরু হয় ঈদের আগের দিন সূর্যাস্তের পর থেকে।


ঈদের সালাতের সময় কখন শুরু ও শেষ হয়।


সূর্যোদয়ের পনর/বিশ মিনিট পর থেকে যোহরের সালাতের পনর/বিশ মিটিন পূর্বে পর্যন্ত ঈদের সালাতের সময় যাকে এ সময়টি সালাতুদ দুহা (অর্থাৎ চাশতের সালাতের) সময়। এ চাশতের সালাত আর ঈদের সালাতের সময় একই।
হাদীসে আছে,
عَنْ جُنْدُبٍ قَالَ كَانَ النَّبِيُّ -صلى الله عليه وسلم- يُصَلِّيْ بِنَا الْفِطْرَ وَالشَّمْسَ عَلٰى قَيْدِ رَمْحَيْنِ وَالأَضْحَى عَلَى قَيْدِ رَمْحٍ
জুনদুব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন যে, নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে নিয়ে ঈদুল ফিতরের সালাত আদায় করতেন সূর্য যখন দু’ বর্শা পরিমাণ উপরে উঠত এবং ঈদুল আয্হা আদায় করতেন সূর্য যখন এক বর্শা পরিমাণ উপরে উঠত। (ফিকহুস সুন্নাহ : ১/৩১৯)


ই‘তিকাফ

ই‘তিকাফ কী? এর হুকুম কী?


দুনিয়াবী সকল কাজ থেকে মুক্ত হয়ে সম্পূর্ণ আল্লাহর ইবাদতের জন্য মসজিদে অবস্থান করাকে ই‘তিকাফ বলা হয়ে থাকে। ইতেকাফ করা সুন্নাত।


ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য কী?


দুনিয়াদারীর ঝামেলা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর ইবাদতে মশগুল হওয়া, বিনয় নম্রতায় নিজেকে আল্লাহর দরবারে সমপর্ণ করা এবং বিশেষ করে লাইলাতুল কদরে ইবাদত করার সুযোগ লাভ করাই ই‘তিকাফের উদ্দেশ্য।


ই‘তিকাফের জন্য কী কী শর্ত পূরণ আবশ্যক?


(ক) মুসলমান হওয়া
(খ) জ্ঞান থাকা
(গ) বড় নাপাকী থেকে পবিত্র থাকা, গোসল ফরয হলে গোসল করে নেয়া।
(ঘ) মসজিদে ই‘তিকাফ করা।
কাজেই কাফির-মুশরিক, অবুঝ শিশু, পাগল ও অপবিত্র লোক এবং হায়েয-নিফাস অবস্থায় নারীদের ই‘তিকাফ শুদ্ধ হবে না।


ই‘তিকাফের রুকন কয়টি ও কী কী?


এর রুকন ২টি :
(ক) নিয়ত করা
(খ) মাসজিদে অবস্থান করা, নিজ বাড়ীতে বা অন্য কোথাও ই‘তিফাক করলে তা শুদ্ধ হবে না।


মেয়েরা কি নিজ বাসগৃহে ই‘তিকাফ করতে পারবে?


রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যামানায় নারীরা মসজিদে ই‘তিকাফ করতেন।


ই‘তিকাফ অবস্থায় কী কী কাজ নিষিদ্ধ?


তা হল :
(১) স্বামী স্ত্রীর মিলন, স্ত্রীকে চুম্বন ও স্পর্শ করা,
(২) মাসজিদ থেকে বের হওয়া। বেচাকেনা, চাষাবাদ, এমনকি রোগীর সেবা ও জানাযায় অংশ গ্রহণের জন্যও মাসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয নয়। বের হলে ইতেকাফ বাতিল হয়ে যাবে।


বিশেষ প্রয়োজনে ই‘তিকাফ অবস্থায় মাসজিদ থেকে বের হতে পারবে কি?


মাসজিদের গন্ডির মধ্যে ব্যবস্থা না থাকলে শুধুমাত্র মানবিক প্রয়োজনে প্রস্রাব-পায়খানা, খাওয়া-দাওয়া ও পবিত্রতা অর্জনের জন্য মাসজিদ থেকে বের হওয়া জায়েয আছে, দলীল :
عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ : كَانَ النَّبِيُّ -صلى الله عليه وسلم- إِذَا اعْتَكَفَ لاَ يَدْخُلُ الْبَيْتَ إِلاَّ لِحَاجَةِ الإِنْسَانَ
‘আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, একান্ত (পেশাব-পায়খানার) প্রয়োজন পূরণ ছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদ ছেড়ে বাড়িতে প্রবেশ করতেন না।’ (মুসলিম : ২৯৭)
তবে মাসজিদে এসব ব্যবস্থা থাকার পর যদি কেউ বাইরে যায় তাহলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
ই‘তিকাফ অবস্থায় এক রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর স্ত্রী সাফিয়াকে ঘরে পৌঁছিয়ে দিয়ে এসেছিলেন। (বুখারী)


কী কী কারণে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়?


নিম্ন বর্ণিত যে কোন একটি কাজ করলে ই‘তিকাফ ভঙ্গ হয়ে যাবে।
১. স্বেচ্ছায় বিনা প্রয়োজনে মাসজিদ থেকে বের হলে।
২. কোন শির্ক বা কুফরী কাজ করলে।
৩. পাগল বা বেঁহুশ হয়ে গেলে।
৪. নারীদের হায়েয-নিফাস শুরু হয়ে গেলে।
৫. স্ত্রীসহবাস বা যে কোন প্রকার যৌনসম্ভোগ করলে।


ই‘তিকাফ অবস্থায় কী কী কাজ করা বৈধ অর্থাৎ মুবাহ?


ই‘তিকাফকারীদের জন্য নিম্নোক্ত কাজ করা বৈধ :
১. একান্ত প্রয়োজনীয় কথাবার্তা বলা।
২. চুল আঁচড়ানো, মাথা মুণ্ডানো, নখ কাটা, শরীর থেকে ময়লা পরিষ্কার করা, এবং সুগন্ধি ব্যবহার ও উত্তম পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করা।
৩. মসজিদের ভিতরে পানাহার করা, ঘুমানো এবং বিশেষ প্রয়োজনে বিবাহের কাবিননামা ও ক্রয়-বিক্রয়ের চুক্তিও সম্পাদন করা যাবে।


ই‘তিকাফকারীর দায়িত্ব ও করণীয় কাজ কী কী? এবং তাঁর কী ধরনের ইবাদত করা উচিত?


উত্তম হল নফল ইবাদত বেশি বেশি করা। যেমন সালাত আদায়, কুরআন তিলাওয়াত ও অধ্যয়ন করা, যিকর-আযকার ও তাসবীহ, তাহলীল করা অর্থাৎ সুবহানাল্লাহ, আল-হামদুলিল্লাহ, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার, তাওবাহ-ইস্তেগফার, দু‘আ, দুরূদ ইত্যাদি ইবাদতে সর্বাধিক সময় মশগুল থাকা। তাছাড়া শরীয়া বিষয়ক ইলম চর্চা করা।
পার্থিব ব্যাপারে কথাবার্তা বলা, অনর্থক গল্পগুজব ও আলোচনা থেকে বিরত থাকা উচিৎ, তবে পারিবারিক কল্যাণর্থে বৈধ কোন বিষয়ে অল্পস্বল্প কথাবার্তা বলার মধ্যে কোন দোষ নেই।


ই‘তিকাফ শুধুই রমযান মাসে? নাকি অন্য সময়ও করা যায়?


বৎসরের যে কোন সময় ই‘তিকাফ করা যায়। এজন্য নির্ধারিত ও নির্দিষ্ট কোন দিন তারিখ নেই। যিনি যখন চাইবেন তখনি ই‘তিকাফ করতে পারবেন। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার শাওয়াল মাসেও ই‘তিকাফ করেছেন। ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু একবার মাত্র এক রাত ই‘তিকাফ করেছিলেন।


ই‘তিকাফের জন্য কোনটি উত্তম সময়?


রমযান মাস হচ্ছে ই‘তিকাফের উত্তম সময়। আরো উত্তম হচ্ছে রমযানের শেষ দশদিন ই‘তিকাফ করা।


সর্বনিম্ন কী পরিমাণ সময় ই‘তিকাফ করা যায়?


এটি একটি মতবিরোধপূর্ণ মাসআলা। শাইখাইনের মতে ই‘তিকাফের ন্যূনতম সময়সীমা ১দিন। কেননা, হানাফী মতে ই‘তিকাফের জন্য রোযা শর্ত। আর রোযা ১ দিনের কমে পূর্ণ হয় না।


ই‘তিকাফ কখন শুরু ও শেষ করব?


ফযরের সালাত আদায় করে বা সূর্যাস্তের পর ই‘তিকাফে প্রবেশ করা সুন্নাত/মুস্তাহাব। আর শেষ করবে ঈদের চাঁদ দেখা গেলে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমনটিই করতেন।


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কতবার ই‘তিকাফ করেছেন?


প্রত্যেক রমাযানেই তিনি শেষ দশ দিন ই‘তিকাফ করতেন। কিন্তু জীবনের শেষ রমযানে তিনি ই‘তিকাফ করেছিলেন ২০ দিন। এভাবে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কোন বছরই তিনি ই‘তিকাফ থেকে বিরত থাকেননি। (বুখারী)


ই‘তিকাফ কত প্রকার ও কী কী?


ইসলামী শরীয়তে ই‘তিকাফ ৩ প্রকার।
(ক) ওয়াজিব ই‘তিকাফ : ওলামায়ে কেরামের ঐকমত্যে ওয়াজিব ই‘তিকাফ হলো মানতের ই‘তিকাফ। আল্লাহ তা‘আলা বলেন,
﴿ وَلۡيُوفُواْ نُذُورَهُمۡ ... ٢٩ ﴾ [الحج: ٢٩] 
অর্থাৎ ‘‘তারা যেন তাদের মানৎ পূর্ণ করে।’’ (সূরা হাজ্জ : ২৯)
(খ) সুন্নাত ই‘তিকাফ : রমযানের শেষ ১০ দিনের ই‘তিকাফ। সুন্নাতে মুয়াক্কাদা। যেমন :
كَانَ رَسُوْلُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- يَعْتَكِفُ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযানে শেষ দশদিন ইতিকাফ করতেন।’ (বুখারী : ২০২৫; মুসলিম : ১১৭২)
(গ) মুস্তাহাব ই‘তিকাফ : উল্লেখিত দু’প্রকার ব্যতীত বাকী সব মুস্তাহাব ইতেকাফ।

লাইলাতুল কদর

লাইলাতুল কদরের মর্যাদা, বৈশিষ্ট্য ও ফযীলাত জানতে চাই।


(১) এ রাতে আল্লাহ তা‘আলা পুরা কুরআন কারীমকে লাউহে মাহফুয থেকে প্রথম আসমানে নাযিল করেন। তাছাড়া অন্য আরেকটি মত আছে যে, এ রাতেই কুরআন নাযিল শুরু হয়। পরবর্তী ২৩ বছরে বিভিন্ন সূরা বা সূরার অংশবিশেষ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঘটনা ও অবস্থার প্রেক্ষিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র উপর অবতীর্ণ হয়।
(২) এ এক রজনীর ইবাদত হাজার মাসের ইবাদতের চেয়েও উত্তম।
(৩) এ রাতে পৃথিবীতে অসংখ্য ফেরেশতা নেমে আসে এবং তারা তখন দুনিয়ার কল্যাণ, বরকত ও রহমাত বর্ষণ করতে থাকে।
(৪) এটা শান্তি বর্ষণের রাত। এ রাতে ইবাদত গুজার বান্দাদেরকে ফেরেশতারা জাহান্নামের আযাব থেকে মুক্তির বাণী শুনায়।
(৫) এ রাতের ফাযীলত বর্ণনা করে এ রাতেই একটি পূর্ণাঙ্গ সূরা নাযিল হয়। যার নাম সূরা কদর।
(৬) এ রাতে নফল সালাত আদায় করলে মুমিনদের অতীতের সগীরা গুনাহগুলো মাফ করে দেয়া হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ قَامَ لَيْلَةُ الْقَدْرِ إِيْمَانًا وَّاحْتِسَابًا غُفِرَ لَهُ مَا تَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থ : যে ব্যক্তি ঈমান ও সাওয়াব লাভের আশায় কদরের রাতে নফল সালাত আদায় ও রাত জেগে ইবাদত করবে আল্লাহ তার ইতোপূর্বের সকল সগীরা (ছোট) গুনাহ ক্ষমা করেদেন। (বুখারী : ১৯০১; মুসলিম : ৭৬০)


কোন রাতটি লাইলাতুল কদর?


এ প্রশ্নের উত্তর স্বরূপ হাদীসে নিম্নবর্ণিত বাণী রয়েছে :
[১] এ রাতটি রমযান মাসে। আর এ রাতের ফযীলত কিয়ামত পর্যন্ত জারী থাকবে।
[২] এ রাতটি রমাযানের শেষ দশকে। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
تَحَرُّوْا لَيْلَةَ الْقَدْرِ فِي الْعَشْرِ الأوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘‘রমাযানের শেষ দশদিনে তোমরা কদরের রাত তালাশ কর।’’ (বুখারী : ২০২০; মুসলিম : ১১৬৯)
[৩] আর এটি রমযানের বেজোড় রাতে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
تَحَرُّوْا لَيْلَةُ الْقَدْرِ فِي الْوِتْرِ مِنَ الْعَشْرِ الأَوَاخِرِ مِنْ رَمَضَانَ
‘‘তোমরা রমাযানের শেষ ১০ দিনের বেজোড় রাতগুলোতে কদরের রাত খোঁজ কর।’’ (বুখারী : ২০১৭)
[৪] এ রাত রমযানের শেষ সাত দিনে হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
فَمَنْ كَانَ مُتَحَرِّيْهَا فَلْيَتَحَرِّهَا فِي السَّبْعِ الأَوَاخِرِ
‘‘যে ব্যক্তি লাইলাতুল কদর (কদরের রাত) অন্বেষণ করতে চায়, সে যেন রমাযানের শেষ সাত রাতের মধ্য তা অন্বেষণ করে।’’ (বুখারী : ২০১৫; মুসলিম : ১১৬৫)
[৫] রমাযানের ২৭ শে রজনী লাইলাতুল কদর হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
ক. উবাই ইবনে কাব হতে বর্ণিত হাদীসে এসেছে, তিনি বলেন যে,
وَاللهِ إِنِّيْ لأَعْلَمُ أَيُّ لَيْلَةٍ هِيَ اللَّيْلَةُ الَّتِيْ أَمَرَنَا رَسُوْلُ اللهِ -صلى الله عليه وسلم- بِقِيَامِهَا هِىَ لَيْلَةُ سَبْعٍ وَعِشْرِيْنَ
আল্লাহর শপথ করে বলছি, আমি যতদূর জানি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে যে রজনীকে কদরের রাত হিসেবে কিয়ামুল্লাইল করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন তা হল রমাযানের ২৭ তম রাত। (মুসলিম : ৭৬২)
(খ) আব্দুল্লাহ বিন ‘উমার থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ كَانَ مُتَحَرِّيْهَا فَلْيَتَحَرِّهَا لَيْلَةَ السَّبْعِ وَالْعِشْرِيْنَ
‘‘যে ব্যক্তি কদরের রাত অর্জন করতে ইচ্ছুক, সে যেন তা রমাযানের ২৭শে রজনীতে অনুসন্ধান করে। (আহমাদ : ২/১৫৭)
[৬] কদরের রাত হওয়ার ব্যাপারে সম্ভাবনার দিক থেকে পরবর্তী দ্বিতীয় সম্ভাবনা হল ২৫ তারিখ, তৃতীয় হল ২৯ তারিখে। চতুর্থ হল ২১ তারিখ। পঞ্চম হল ২৩ তারিখের রজনী।
[৭] সর্বশেষ আরেকটি মত হল- মহিমান্বিত এ রজনীটি স্থানান্তরশীল। অর্থাৎ প্রতি বৎসর একই তারিখে বা একই রজনীতে তা হয় না এবং শুধুমাত্র ২৭ তারিখেই এ রাতটি আসবে তা নির্ধারিত নয়। আল্লাহর হিকমত ও তাঁর ইচ্ছায় কোন বছর তা ২৫ তারিখে, কোন বছর ২৩ তারিখে, কোন বছর ২১ তারিখে, আবার কোন বছর ২৯ তারিখেও হয়ে থাকে।


কেন এ রাতকে অস্পষ্ট করে গোপন রাখা হয়েছে। এটা স্পষ্ট করে নির্দিষ্ট করে বলা হয় নি কেন?


এ রাতের পুরস্কার লাভের আশায় কে কত বেশি সক্রিয় অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এবং কত বেশি সচেষ্ট হয়, আর কে নাফরমান ও আলসে ঘুমিয়ে রাত কাটায় সম্ভবতঃ এটা পরখ করার জন্যই আল্লাহ তা‘আলা এ রাতকে গোপন ও অস্পষ্ট করে রেখেছেন।


যে রাতটি লাইলাতুল কদর হবে সেটি বুঝার কি কোন আলামত আছে?


হাঁ, সে রাতের কিছু আলামত হাদীসে বর্ণিত আছে। সেগুলো হল :
(১) রাতটি গভীর অন্ধকারে ছেয়ে যাবে না।
(২) নাতিশীতোষ্ণ হবে। অর্থাৎ গরম বা শীতের তীব্রতা থাকবে না।
(৩) মৃদুমন্দ বাতাস প্রবাহিত হতে থাকবে।
(৪) সে রাতে ইবাদত করে মানুষ অপেক্ষাকৃত অধিক তৃপ্তিবোধ করবে।
(৫) কোন ঈমানদার ব্যক্তিকে আল্লাহ স্বপ্নে হয়তো তা জানিয়েও দিতে পারেন।
(৬) ঐ রাতে বৃষ্টি বর্ষণ হতে পারে।
(৭) সকালে হালকা আলোকরশ্মিসহ সূর্যোদয় হবে। যা হবে পূর্ণিমার চাঁদের মত। (সহীহ ইবনু খুযাইমাহ : ২১৯০ ; বুখারী : ২০২১ ; মুসলিম : ৭৬২)


রমাযানের শেষ দশ রাতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কী ধরণের ইবাদত করতেন?


তাঁর ইবাদতের অবস্থা ছিল নিম্নরূপ :
১. প্রথম ২০ রাত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পূর্ণ রাত জাগরণ করতেন না। কিছু সময় ইবাদত করতেন, আর কিছু অংশ ঘুমিয়ে কাটাতেন। কিন্তু রমাযানের শেষ দশ রাতে তিনি বিছানায় একেবারেই যেতেন না। রাতের পুরো অংশটাই ইবাদত করে কাটাতেন।
সে সময় তিনি কুরআন তিলাওয়াত, সালাত আদায় সদাকা প্রদান, যিকর, দু‘আ, আত্মসমালোচনা ও তাওবাহ করে কাটাতেন। আল্লাহর রহমাতের আশা ও তার গজবের ভয়ভীতি নিয়ে সম্পূর্ণ খুশুখুজু ও বিনম্রচিত্তে ইবাদতে মশগুল থাকতেন।
২. হাদীসে এসেছে সে সময় তিনি শক্ত করে তার লুঙ্গি দ্বারা কোমর বেধে নিতেন। এর অর্থ হল, রাতগুলোতে। তাঁর সমস্ত শ্রম শুধু ইবাদতের মধ্যেই নিমগ্ন ছিল। নিজে যেমন অনিদ্রায় কাটাতেন তাঁর স্ত্রীদেরকেও তখন জাগিয়ে দিতেন ইবাদত করার জন্য।
৩. কদরের রাতের ইবাদতের সুযোগ যাতে হাতছাড়া হয়ে না যায় সেজন্য রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শেষ দশদিনের পুরো সময়টাতে ইতেকাফরত থাকতেন। (মুসলিম : ১১৬৭)


মহিমান্বিত লাইলাতুল কদরে আমরা কী কী ইবাদত করতে পারি?


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেভাবে এ রাত কাটাতেন এর পূর্ণ অনুসরণ করাই হবে আমাদের প্রধান টার্গেট। এ লক্ষ্যে আমাদের নিম্নবর্ণিত কাজগুলো করা আবশ্যক :
(ক) নিজে রাত জেগে ইবাদত করা এবং নিজের অধীনস্ত ও অন্যদেরকেও জাগিয়ে ইবাদতে উদ্বুদ্ধ করা।
(খ) লম্বা সময় নিয়ে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ পড়া। এসব সালাতে কিরাআত ও রুকু-সিজদা লম্বা করা। রুকু থেকে উঠে এবং দুই সিজদায় মধ্যে আরো একটু বেশি সময় অতিবাহিত করা, এসময় কিছু দু‘আ আছে সেগুলে পড়া।
(গ) সিজদার মধ্যে তাসবীহ পাঠ শেষে দু‘আ করা। কেননা সিজদাবনত অবস্থায় মানুষ তার রবের সবচেয়ে নিকটে চলে যায়। ফলে তখন দু‘আ কবুল হয়।
(ঘ) বেশি বেশি তাওবা করবে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়বে। ছগীরা কবীরা গোনাহ থেকে মাফ চাইবে। বেশি করে শির্কী গোনাহ থেকে খালেছ ভাবে তাওবা করবে। কারণ ইতিপূর্বে কোন শির্ক করে থাকলে নেক আমল তো কবুল হবেই না, বরং অর্জিত অন্য ভাল আমলও বরবাদ হয়ে যাবে। ফলে হয়ে যাবে চিরস্থায়ী জাহান্নামী।
(ঙ) কুরআন তিলাওয়াত করবে। অর্থ ও ব্যাখ্যাসহ কুরআন অধ্যয়নও করতে পারেন। তাসবীহ তাহলীল ও যিকর-আযকার করবেন। তবে যিকর করবেন চুপিসারে, নিরবে ও একাকী এবং কোন প্রকার জোরে আওয়ায করা ছাড়া। এভাবে যিকর করার জন্যই আল্লাহ কুরআনে বলেছেন :
﴿ وَٱذۡكُر رَّبَّكَ فِي نَفۡسِكَ تَضَرُّعٗا وَخِيفَةٗ وَدُونَ ٱلۡجَهۡرِ مِنَ ٱلۡقَوۡلِ بِٱلۡغُدُوِّ وَٱلۡأٓصَالِ وَلَا تَكُن مِّنَ ٱلۡغَٰفِلِينَ ٢٠٥ ﴾ [الاعراف: ٢٠٥] 
‘‘সকাল ও সন্ধ্যায় তোমার রবের যিকর কর মনে মনে বিনয়ের সঙ্গে ভয়ভীতি সহকারে এবং জোরে আওয়াজ না করে। এবং কখনো তোমরা আল্লাহর যিকর ও স্মরণ থেকে উদাসীন হয়োনা।’’ (আরাফ : ২০৫)
অতএব, দলবেধে সমস্বরে জোরে জোরে উচ্চ স্বরে যিকর করা বৈধ নয়। এভাবে সম্মিলিত কোন যিকর করা কুরআনেও নিষেধ আছে নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও তা করেন নি। যিকরের শব্দগুলো হল: সুবহানাল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ, লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহু আকবার ইত্যাদি।
(চ) একাগ্রচিত্তে দু‘আ করা। বেশি বেশি ও বারবার দু‘আ করা। আর এসব দু‘আ হবে একাকী ও বিনম্র চিত্তে কবুল হওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে। দু‘আ করবেন নিজের ও আপনজনদের জন্য. জীবিত ও মৃতদের জন্য, পাপমোচন ও রহমত লাভের জন্য, দুনিয়ার শান্তি ও আখিরাতের মুক্তির জন্য। তাছাড়া নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এ রাতে নিম্নের এ দু‘আটি বেশি বেশি করার জন্য উৎসাহিত করেছেন :
اَللَّهُمَّ إِنَّكَ عَفُوٌّ تُحِبُّ الْعَفْوَ فَاعْفُ عَنِّيْ
‘‘হে আল্লাহ! তুমি তো ক্ষমার আধার, আর ক্ষমা করাকে তুমি ভালবাস। কাজেই তুমি আমাকে ক্ষমা করে দাও। (তিরমিযী : ৩৫১৩)

বিতরের সালাত

বিতরের সালাত কত রাকআত?


বিতরের সালাতের সর্বনিম্ন সংখ্যা হল এক রাক‘আত এবং সর্বোচ্চ হল ১১ রাকআত।
(ক) বিতরের সালাত ১ রাকআত পড়াও জায়েয আছে। আল্লাহ নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ أَحَبُّ أَن يُّؤْتِرَ بِوَاحِدَةٍ فَلْيَفْعَلْ
অর্থাৎ কেউ যদি ১ রাকআত বিতর পড়তে চায়, তা সে করতে পারে। (আবূ দাউদ : ১৪২২; নাসাঈ : ১৭১২)
(খ) আবার তিন রাকআত বিতর পড়া যায়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
مَنْ أَحَبَّ أَن يُّؤْتِرَ بِثَلاَثٍ فَلْيَفْعَلْ
‘‘যে ব্যক্তি বিতরের সালাত ৩ রাকআত পড়তে চায়, তা সে পড়তে পারে।’’ (আবূ দাউদ : ১৪২২; নাসাঈ : ১৭১২)
(গ) বিতর ৫ রাক‘আতও পড়ার নিয়ম আছে। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ أَحَبَّ أَن يُّؤْتِرَ بِخَمْسٍ فَلْيَفْعَلْ
‘‘কেউ ৫ রাকআত বিতর পড়তে চাইলে তা সে পড়তে পারে।’’ (আবূ দাউদ : ১৪২২; নাসাঈ : ১৭১২)
এভাবে ৭ বা ৯ বা ১১ রাকআত পর্যন্ত বিতরের সালাত আদায় করার সুযোগ আছে, জায়েয আছে।


বিতরের সালাতে কি একবার নাকি দু’বার সালাম ফিরাব?


(ক) এক সালামে বিতর পড়ার দলীল :
মিসওয়ার বিন মাখরামা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন,
دَفَنَّا أَبَا بَكْرٍ لَيْلًا , فَقَالَ عُمَرُ: «إِنِّي لَمْ أُوتِرْ , فَقَامَ وَصَفَفْنَا وَرَاءَهُ , فَصَلَّى بِنَا ثَلَاثَ رَكَعَاتٍ , لَمْ يُسَلِّمْ إِلَّا فِي آخِرِهِنَّ»
রাতের বেলা আমরা আবূ বাকার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) কে দাফন করলাম। অতপর উমার (রাদিয়াল্লাহু আনহু) বললেন, ‘আমি বিতর পড়িনি। এই বলে তিনি দাঁড়ালেন আর আমার তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে গেলাম। এরপর তিনি আমাদের নিয়ে ৩ রাকআত বিতর পড়তেন। শেষ রাকআতের আগে তিনি সালাম ফিরাতেন না (এক সালামে তিন রাকাত বিতর পড়তেন)। (ত্বহাবী : ১৭৪২)
(খ) দু’ সালামে বিতর পড়ার দলীল :
عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عُمَرَ كَانَ يُسَلِّمُ بَيْنَ الرَّكْعَةِ وَالرَّكْعَتَيْنِ فِي الْوِتْرِ حَتَّى بِأَمْرِ بِبَعْضِ حَاجَتِهِ
আবদুল্লাহ ইবনে ‘উমার রাদিয়াল্লাহু আনহু (বিতরে সালাত) প্রথম দুই রাকআত শেষ করে সালাম ফিরাতেন এবং পরে শেষ (তৃতীয়) রাকআতে আবার সালাম ফিরাতেন। প্রথম দুই রাকআতের সালাম ফিরানের পর প্রয়োজনে কোন কাজের নির্দেশও দিতেন। (বুখারী : ৯২১)


বিতরের সালাতের আগেই জামাত ছেড়ে যাওয়া কি জায়েয?


ইমাম বিতর শেষ না করা পর্যন্ত জামাআত ছেড়ে চলে যাওয়া ঠিক নয়। কারণ বিতর দ্বারা পুরো রাত্রি জাগরণের অর্থাৎ কিয়ামুল্লাইলের পূর্ণ সওয়াব অর্জিত হয়।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
أَنَّهُ مَنْ قَامَ مَعَ الإمَام حَتَّى يَنْصَرِفَ كُتِبَ لَهُ قِيَامُ لَيْلَةٍ
অর্থাৎ ইমাম নামায শেষ না করা পর্যন্ত যে ব্যক্তি ইমামের সাথে (জামাআতে) তারাবীহ পড়ল তার জন্য পূর্ণ রাত নফল পড়ার সাওয়াব লেখা হয়ে গেল। (তিরমিযী : ৮০৬)


তারাবীহর সালাত

 

তারাবীহ অর্থ কি? এ সালাতকে কেন তারাবীহ নামকরণ করা হল?


তারাবীহ শব্দের অর্থ বিশ্রাম করা। তারাবীহ বহু দীর্ঘায়িত একটি সালাত। প্রতি চার রাকআত শেষে যাতে একটু বিশ্রাম গ্রহণ করতে পারে সেজন্য এর নামকরণ করা হয়েছে তারাবীহ।


রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র তারাবীহর সালাত কী ধরণের বৈশিষ্টমন্ডিত ছিল?


লম্বা ও অনেক আয়াত এবং দীর্ঘ সময় নিয়ে তিনি তারাবীহ পড়তেন।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ রাতের একাকী সকল সালাতই ছিল অতি দীর্ঘ। এমনকি কিয়াম, রুকু, সাজদা সবই ছিল খুব লম্বা ও ধীরস্থির।
আসসায়িব ইবনে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন :
كَانَ الْقَارِئُ يَقْرَأُ بِالْمِئْيِنَ يَعْنِي بِمِئَاتِ الآيَاتِ حَتَّى كُنَّا نَعْتَمِدُ عَلَى الْعَصَى مِنْ طُوْلِ الْقِيَامِ
অর্থাৎ ইমাম (পাঠক) সাহেব তারাবীহতে শত শত আয়াত পড়তেন। ফলে সুদীর্ঘ সময় দাঁড়ানোর কারণে আমরা লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতাম। (মুয়াত্তা : ১/১১৪)


তারাবীহ সর্বপ্রথম কোথায় চালু হয়।


আল্লাহর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বপ্রথম মসজিদে নববীতে তারাবীহর সালাত সুন্নাত হিসেবে চালু করেন।


রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কি নিয়মিত প্রত্যহ জামা‘আতের সাথে তারাবীহ পড়তেন?


না। সাহাবায়ে কিরাম দুই বা তিন রাত্রি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র ইমামতিতে তারাবীহ পড়েছিলেন। উম্মাতের উপর এ সালাত ফরয হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরে জামাআতের সাথে মসজিদে তারাবীহ পড়া ছেড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেন,
وَلَمْ يَمْنَعْنِيْ مِنَ الْخُرُوْجِ إِلَيْكُمْ إِلاَّ أَنِّيْ خَشِيْتُ أَنْ تُفْتَرَضَ عَلَيْكُمْ وَذَلِكَ فِيْ رَمَضَانَ
অর্থাৎ (তারাবীহর সালাতে মসজিদে তোমরা একত্রিত হয়ে আমার জন্য যেভাবে অপেক্ষা করছিলে তা সবই আমি দেখেছি) কিন্তু আমার ভয় হচ্ছিল (আমি নিয়মিত এ সালাত আদায় করলে) তা তোমাদের জন্য ফরয হয়ে যেতে পারে। সে কারণে আমি (এ সালাতের জন্য) ঘর থেকে বের হইনি। আর এ ঘটনাটি ছিল রমযান মাসের (কোন এক রাতে)। (বুখারী : ২০১২; মুসলিম : ৭৬১)


তারাবীহর সালাত কত রাক‘আত?






এটি একটি ইখতিলাফী অর্থাৎ মতবিরোধপূর্ণ মাস্আলা। কেউ কেউ বলেছেন, বিতরসহ তারাবীহ ৪১ রাক‘আত। অর্থাৎ বিতর ৩ রাকআত হলে তারাবীহ হবে ৩৮ রাক‘আত। অথবা বিতর ১ রাকআত ও তারাবীহ ৪০ রাকআত। এভাবে তারাবীহ ও বিতর মিলে:
কেউ বলেছেন ৩৯ রাকআত (তারাবীহ ৩৬ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ২৯ রাকআত (তারাবীহ ২৬ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ২৩ রাকআত (তারাবীহ ২০ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ১৯ রাকআত (তারাবীহ ১৬ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ১৩ রাকআত (তারাবীহ ১১ + বিতর ৩)
কেউ বলেছেন ১১ রাকআত (তারাবীহ ৮ + বিতর ৩)
২০ রাকআত তারাবীহ সালাতের পক্ষে দলীল
(ক) বিতর ছাড়া ২০ রাক‘আত তারাবীহ সালাতের পক্ষে দলীল হল মুসান্নাফে আঃ রায্যাক হতে বর্ণিত ৭৭৩০ নং হাদীস, যেখানে বর্ণিত হয়েছে :
أَنَّ عُمَرَ جَمَعَ النَّاسَ فِي رَمَضَانَ عَلَى أُبَي بنِ كَعَبٍ وَعَلَى تَمِيْمِ الدَّارِيْ عَلَى إِحْدى وَعِشْرِيْنَ مِنْ رَكْعَةِ يَقْرَؤُنَ بِالْمَئِيين
উমার (রাযি.) রমযানে উবাই ইবনে কাব ও তামীম আদদারীকে ইমামতিতে লোকদেরকে একুশ রাকআত সালাতের প্রতি জামাআতবদ্ধ করেছিলেন। (অর্থাৎ তারাবীহ ২০ ও বিতর ১ রাকআত)
(খ) আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস বলেছেন যে,
كَانَتْ صَلاَةُ النَّبِيِّ -صلى الله عليه وسلم- ثَلاَثَ عَشَرَةَ رَكْعَةً يَعْنِيْ مِنَ اللَّيْلِ
‘‘নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’র রাতের সালাত ছিল ১৩ রাক‘আত।’’ (বুখারী : ১১৩৮; মুসলিম : ৭৬৪)
(গ) মা আয়িশাহ  (রাঃ) বলেন,
مَا كَانَ يَزِيْدُ فِيْ رَمَضَانَ وَلاَ غَيْرِهِ عَلَى إِحْدى عَشَرَةَ رَكْعَةً
তিনি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রমযান ও অন্য সময়ে (রাতে) ১১ রাকআতের অধিক সালাত আদায় করতেন না। (বুখারী : ২০১৩; মুসলিম : ৭৩৮) অর্থাৎ তারাবীহ ৮ রাকাআত এবং বিতর ৩ রাকাআত।
(ঘ) ইবনে ইয়াযিদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন,
أَمَرَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ أُبَيْ بْنِ كَعَبٍ وَتَمِيْمَا الدَّارِيِّ أَن يَّقُوْمَ لِلنَّاسِ بِإحْدى عَشَرَةَ رَكْعَةٍ
‘উমার ইবনু খাত্তাব রাদিয়াল্লাহু আনহু (তার দুই সঙ্গী সাহাবী) উবাই ইবনে কাব তামীম আদদারীকে এ মর্মে নির্দেশ দিলেন যে, তারা যেন লোকদেরকে নিয়ে (রমযানের রাতে) ১১ রাকআত কিয়ামুল্লাইল (অর্থাৎ তারাবীহর সালাত) আদায় করে। (মুয়াত্তা মালেক : ১/১১৫)
উল্লেখ্য যে, সৌদী আরবের মসজিদগুলোতে তারাবীহ ও বিতর মিলে ১১ বা ১৩ রাকআত পড়লেও মাক্কার হারামে ও মাদ্বীনার মসজিদে নববীতে তারাবীহ ২০ এবং বিতর ৩ মিলিয়ে মোট ২৩ রাকআত পড়ে থাকে।
ফুটনোটঃ মূলত তারাবির মূল বিষয় লম্বা কিয়ামে সালাত আদায় করা অর্থাৎ দীর্ঘক্ষণ দাড়িয়ে আদায় করা। রাসুল (সাঃ) এর ৮ রাকাত শেষ করতে প্রায় ফজর হয়ে যেত। বর্তমানে আমাদের উপমহাদেশে এই সালাতের রাকাত সংখ্যা নিয়ে প্রচুর বিরোধ দেখা যায় এমনকি এটা নিয়ে বিভিন্ন দলে উপদলেও মানুষ বিভক্ত হয়ে যায় এবং কোথাও বা বিবাদে লিপ্ত হতে দেখা যায়।

মূল বিষয় হচ্ছে আপনি ইমামের সাথে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কিয়াম করবেন তা ৮ রাকাত হোক বা ২০ রাকাত হোক। রাকাতের সংখ্যা নিয়ে নিজেদের ভিতরে বিভেদ সৃষ্টির কোন অবকাশ নেই কেননা রাসুল (সাঃ) রাকাতের সংখ্যা ফিক্সড করে দেন নাই বরং তা উন্মুক্ত। আপনি যদি একাকী ঘরে আদায় করেন তো ২ রাকাত ২ রাকাত করে যত রাকাত খুশি আদায় করতে পারেন আর শেষ করতে চাইলে ১ রাকাত বিতর আদায় করে নিবেন (বিতর ১, ৩, ৫ বা ৭, ৯ রাকাত দিয়ে আদায় করা যায়)।

তবে আমাদের দেশে দ্রুতবেগে কিরাত করে যেভাবে তারাবী আদায় করা হয় তা কোন ভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় এবং সুন্নাতের বরখেলাপ। সূরা কিরাত হতে হবে স্বাভাবিক গতিতে, ১ ঘণ্টায় ২০ রাকাত আদায় করা থেকে ১ ঘণ্টায় ৮ রাকাত উত্তম তেমনি ১ ঘণ্টায় ৮ রাকাত থেকে দেড় ঘণ্টার ২০ রাকাত উত্তম।

মূল বিষয় কত সময় এবং কত সুন্দর ভাবে আপনি এই সালাত আদায় করেছেন এটাই মুখ্য, রাকাতের সংখ্যা মুখ্য নয়।

সংযুক্তিঃ বাংলা হাদিস
 

তারাবীহর সংখ্যার মতবিরোধের মধ্যে কোনটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য?


মালেকী মাযহাবের ইমাম মালেক (রহঃ) বলেছেন, একশ বছরেরও বেশি সময় ধরে লোকেরা ৩৬ রাকআত তারাবীহ পড়েছে। শাফেঈ মাযহাবের ইমাম শাফেঈ (রহঃ) বলেছেন, তিনি তারাবীহ মদ্বীনায় ৩৬ এবং মাক্কায় ২০ রাকআত পড়তে দেখেছেন। সৌদী আরবের গ্র্যান্ড মুফতী সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন আল্লামা মুহাম্মাদ বিন সালেহ আল উসাইমীন (রহ.) ১০ ও আট রাকআতের মাসআলাকে প্রাধান্য দিয়েছেন।
এ জাতীয় মত পার্থক্যের সমাধানকল্পে শাইখুল ইসলাম ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহ.) বলেছেন, অধিক সংখ্যক রাকআত পড়াই উত্তম। আর যদি কেউ কম সংখ্যক রাকআত পড়তে চায় তাহলে তার উচিৎ হবে তিলাওয়াত, কিয়াম, রুকু ও সিজদা দীর্ঘ করা। তিনি আরো বলেছেন যে, তারাবীহকে রাকআত সংখ্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে বরং সময় ব্যয়ের পরিমাণ দিয়ে মূল্যায়ন করা উচিৎ। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু ১১ রাকআতের মধ্যে ৫ ঘণ্টা সময় অতিবাহিত করেছেন। সালাতের কিয়ামে এত দীর্ঘ সময় কেটে যেত যার কারণে সাহাবীগণ লাঠির উপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন।
সবশেষে ইমাম ইবনু তাইমিয়্যা (রহঃ) আরেকটি মত ব্যক্ত করে বলেছেন, সার্বিক বিশ্লেষণে তারাবীহ ২০ রাকআত পড়াই উত্তম। কারণ এটা ১০ ও ৪০ রাকআতের মাঝামাঝি এবং বেশির ভাগ মুসলমানের আমলও এরই উপর।
তবে অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই যে, আমাদের দেশে তারাবীহ যেভাবে তাড়াহুড়া করে পড়া হয় তা পরিহার করে বিশুদ্ধ ও ধীরস্থির তিলাওয়াত, রুকু থেকে উঠার পর এবং দু’ সিজদার মাঝে আরো একটু সময়ক্ষেপণ করা, সুন্নাত মোতাবিক ও ধীরস্থিরভাবে রুকু-সিজদাহ ইত্যাদি সুন্দর করে তারাবীহ আদায় করা অত্যাবশ্যক। যে পদ্ধতিতে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাতের সালাত আদায় করতেন আমাদেরও উচিৎ সে তরীকামত আদায় করা।
 

তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের ফযীলত জানতে চাই।


(ক) রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
مَنْ قَامَ رَمَضَانَ إِيْمَانًا وَّاِحْتِسَابًا غُفِرَلَهُ مَاتَقَدَّمَ مِنْ ذَنْبِهِ
অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঈমান অবস্থায় সাওয়াবের আশায় রাতে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ আদায় করবে, আল্লাহ তাঁর পূর্ববতী (সগীরা) গুনাহগুলো মাফ করে দেবেন। (বুখারী : ৩৭; মুসলিম : ৭৫৯)
إِيْمَانًا ঈমান অবস্থায় অর্থ হল, এমন বিশ্বাস স্থাপন করা যে, আল্লাহ তাকে এ কাজের বদলা দিবেন এবং اِحْتِسَابًا অর্থ হল, এমনভাবে সাওয়াব আশা করবে যে, রাতের এ সালাত আদায় কোন মানুষকে দেখাবার বা শুনাবার জন্য নয় বরং শুধুমাত্র আল্লাহকে খুশি করার জন্য এবং তা শুধুমাত্র আল্লাহরই কাছ থেকে পুরস্কার লাভের আশায়।
(খ) অন্য হাদীসে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
أََفْضَلُ الصَّلاَةِ بَعْدَ الْفَرِيْضَةِ صَلاَةُ اللَّيْلِ
ফরয সালাতের পর সর্বোত্তম সালাত হল রাতের সালাত (অর্থাৎ তাহাজ্জুদের সালাত)। (মুসলিম : ১১৬৩)


তারাবীহ সালাতের জামাআতে নারীদের শরীক হওয়া কি জায়েয?


ফিতনা-ফ্যাসাদের আশঙ্কা না থাকলে মাসজিদে তারাবীহর জামা‘আতে হাজির হওয়া মেয়েদের জন্য জায়েয আছে। আল্লাহর নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
لاَ تَمْنَعُوْا إِمَاءَ اللهِ مَسَاجِدَ اللهِ
‘‘তোমরা আল্লাহর বান্দা নারীদেরকে মাসজিদে যেতে নিষেধ করো না।’’ (বুখারী : ৯০০; মুসলিম : ৪৪২)


নারীরা মাসজিদে গেলে তাদের চালচলন ও পোশাক আশাক কী ধরনের হওয়া উচিত?


সম্পূর্ণ শরীয়াতসম্মত পর্দা করে মসজিদে যাবে। বাহারী ও রঙ বেরঙের বোরকা ও টাইট-ফিট পোশাক পরবে না। গল্পগুজব ও আওয়াজ করে কথা বলবে না। মেয়েদের নির্ধারিত স্থানে গিয়ে সালাত আদায় করবে। ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পরপরই মসজিদ থেকে বেরিয়ে যাবে।


জামাআতে সালাত আদায় করলে নারীদের কোথায় দাঁড়ানো উত্তম?


নারীরা পিছনে দাঁড়াবে। এটাই সুন্নাত। তারা যত পিছনে দাঁড়াবে ততই উত্তম। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
خَيْرُ صُفُوْفِ الرِّجَالِ أَوَّلُهَا وَشَرُّهَا آخِرُهَا وَخَيْرُ صُفُوْفِ النِّسَاءِ آخِرُهَا وَشَرُّهَا أَوَّلُهَا
পুরুষদের উত্তম কাতার হলো প্রথম কাতার আর নিকৃষ্ট হলো শেষ কাতার। পক্ষান্তরে মহিলাদের জন্য উত্তম হলো শেষ কাতার আর নিকৃষ্ট হলো প্রথমকাতার। (মুসলিম : ৪৪০)


ঋতুবতী মহিলাদের সিয়াম

 

ঋতুবতী মহিলা বলতে কী বুঝায়?


বালেগ হওয়ার পর মহিলাদের প্রতিমাসে ৬/৭ দিন বা কমবেশি মেয়াদে শরীর থেকে রক্তক্ষরণ হয়। এটাকে বলা হয় মাসিক ঋতুস্রাব বা হায়েয। আর সন্তান প্রসবের পর রক্ত রক্তক্ষরণ হয় প্রায় ৪০ দিন ব্যাপী। এটাকে বলা হয় নিফাস। এ দু’ অবস্থায়ই মহিলাদেরকে ঋতুবর্তী বলা হয়। তখন তারা নাপাক বা অপবিত্র থাকে।


এ দু’ অবস্থায় মেয়েদের কী কী কাজ ও ইবাদত নিষিদ্ধ?


সালাত, সাওম ও স্বামী-স্ত্রীর যৌন মিলন, কুরআন স্পর্শ করা, মাসজিদে যাওয়া ও কাবা তাওয়াফ করা।


হায়েয ও নিফাস থেকে পবিত্র হওয়ার পর সালাত, রোযা কীভাবে কাযা করবে?


সালাত কাযা করতে হবে না। তবে এ কারণে যতটা রোযা ভাঙ্গা গেছে ঠিক ততটা রোযাই আবার কাযা করতে হবে।
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন :
فَنُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّوْمِ وَلاَ نُؤْمَرُ بِقَضَاءِ الصَّلاَةِ
‘‘সিয়াম কাযা করতে আমাদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছিল, কিন্তু সালাত কাযা করতে আমাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় নি।’’ (মুসিলম : ৩৩৫)


যদি কোন সিয়াম পালনকারী নারীর সূর্যাস্তের সামান্য কিছু পূর্বে মাসিক স্রাব শুরু হয়ে যায় তাহলে কি করবে?


উক্ত সিয়াম বাতিল হয়ে যাবে এবং পরে এটা কাযা করতে হবে।


যদি কোন মেয়ে রমযান মাসের দিনের বেলায় কোন অংশে হায়েয বা নিফাস থেকে পবিত্র হয় তাহলে দিবসের বাকী অংশে কি রোযা রাখবে?


না, রাখবে না। কারণ সিয়ামের শুরু দিনের প্রথম থেকে হতে হবে। কাজেই এ সিয়াম পরে কাযা করবে। তবে দিনের বাকী অংশে খাওয়া দাওয়া থেকে বিরত থাকবে।


যদি ফজরের সামান্য আগে হায়েয বা নিফাস থেকে পবিত্র হয় তাহলে কি করবে?


তাহলে ঐ দিনে সিয়াম পালন করা তার উপর ফরয। এমনকি গোসল করার সময় না থাকলেও।


ফজরের পূর্বক্ষণে হায়েয বা নিফাস থেকে পবিত্র হল। কিন্তু গোসল করার সময় পেল না। এ অবস্থায় কি রোযা রাখার নিয়ত করবে?


হা, এ অবস্থায় রোযার নিয়ত করতেই হবে। ঐ দিন সিয়াম পালন করা তার ফরয। ফরয গোসল ছাড়াই রোযা শুরু করতে পারবে। কিন্তু ফজরের সালাত পড়তে হবে গোসলের কাজ সেরে।


অভ্যাসের কারণে যে মহিলা জানে যে, আগামী কাল থেকে তার মাসিক শুরু হবে সে রোযার নিয়ত করবে কি করবে না?


অবশ্যই রোযার নিয়ত করবে। যতক্ষণ পর্যন্ত রক্ত দেখতে না পাবে ততক্ষণ রোযা ভঙ্গ করবে না।


সন্তান প্রসবের কারণে নিফাসওয়ালী মহিলা যদি ৪০ দিনের পূর্বেই পাক হয়ে যায় তাহলে কী করবে?


গোসল করে পাক হয়ে রোযা রাখা ও নামায পড়া শুরু করে দিবে।


নিফাসওয়ালী নারীর যদি ৪০ দিন পার হওয়ার পরও রক্ত বন্ধ না হয় তাহলে কি করবে?


চল্লিশতম দিন পার হলে গোসল করে রোযা রাখা শুরু করবে। অতিরিক্ত মেয়াদের এ অবস্থাকে ধরে নেবে ইস্তেহাদা বা রক্তপ্রদর রোগ। আর রক্তপ্রদর হলে রোযা ভঙ্গ করা জায়েয নয়।


যদি কোন নারী মনে করে যে, টেবলেট খেয়ে হায়েয বা মাসিক বন্ধ করে ফরয রোযা চালিয়ে যাবে। এ কাজটির হুকুম কী?


এটাকে জায়েয তবে কৃত্রিম উপায়ে স্বাভাবিক ঋতুস্রাবকে দেরী করানো উচিৎ নয়। এ ব্যাপারে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া যেতে পারে।


হায়েয ও নিফাসওয়ালী মহিলা কীভাবে বুঝবে যে সে ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়ে গেছে?


যখন দেখবে যে তার ঋতুস্রাব সাদা রঙে পরিণত হয়ে গেছে, তখন বুঝবে সে পাক হয়ে গেছে। আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলতেন :
لاَ تَعْجَلْنَ حَتَّى تَرَيِنَّ الْقِصَّةَ الْبَيْضَاءَ
‘‘তোমরা তাড়াহুড়া করে হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে মনে করো না। যতক্ষণ না শুভ্র পানি দেখতে পাও।’’ (বুখারী : ৩১৯)


যে মহিলা বালেগ হওয়ার পর কোন রোযা রাখে নি। সে এখন লজ্জিত, অনুতপ্ত ও তাওবাহ করতে চায়। সে কি করবে?


এখন থেকে ভবিষ্যতে আর সিয়াম ভঙ্গ না করার দৃঢ় প্রত্যয় ব্যক্ত করবে। পূর্বের গোনাহের জন্য আল্লাহর কাছে মাফ চাইবে, তাওবাহ করবে। ছেড়ে দেয়া প্রত্যেক রোযার জন্য একটি করে রোযা কাযা করতে হবে।


যে মহিলা মাসিকের সময় না রাখা রোযাগুলো কাযা করেনি সে কি করবে?


উপরে বর্ণিত (পূর্বের প্রশ্নে) একই কায়দায় সমপরিমাণ রোযা কাযা করবে।


স্বামী উপস্থিত। স্ত্রী নফল বা সুন্নাত রোযা রাখতে চায়, কি করবে?


স্বামীর অনুমতি নিতে হবে। নতুবা জায়েয নয়।


স্ত্রী ফরয রোযা রাখছে। এমতাবস্থায় স্বামীকে সহবাসের অনুমতি দিল। এর হুকুম কী?


স্বামীর মতই স্ত্রীকেও এ অপরাধে কাযা ও কাফফারা দিতে হবে। অর্থাৎ দু’জনের প্রত্যেককেই একাধারে ৬০ দিন রোযা রাখতে হবে। মাঝখানে কোন বিরতি দেয়া যাবে না। বিরতি দিলে শুরু থেকে আবার নতুন করে ১+৬০= ৬১ রোযা রাখবে। এভাবে চালিয়ে যাবে। এতে অপারগ হলে প্রতি একটা রোযার জন্য ৬০ জন মিসকীনকে এক বেলা খানা খাওয়াতে হবে।


স্রাবের কারণে কাযা সিয়াম কোন উযর বা যুক্তিসঙ্গত কারণ ছাড়া পরবর্তী রমযান চলে আসার আগে কাযা করতে পারল না। এ অবস্থায় কি করবে?


এরূপ বিলম্বিত হওয়া গোনাহের কাজ। এজন্য তাওবাহ করতে হবে এবং পূর্বে বর্ণিত নিয়মে কাযা করবে অর্থাৎ যে কটা রোযা ভাঙ্গা হয়েছে শুধু সে ক’টিই কাযা করতে হবে। চলতি রমযানের ফরয রোযা শেষ করার পর।


কাযা ও কাফফারা উভয় ওয়াজিব। সেক্ষেত্রে কাযা কোনটি ও কাফফারা কোনটি?


কাযা হল সিয়ামের বদলে সিয়াম পালন করা। আর কাফফারা হলো মিসকীনকে খাবার খাওয়ানো।

গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের সিয়াম

 গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীরা কি সিয়াম পালন করবে নাকি ভঙ্গ করবে?


গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারীণী সিয়াম পালন করলে নিজের বা সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকুক বা না থাকুক উভয় অবস্থায় তাদের সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েজ আছে এবং পরে তা কাযা করে নেবে। পরে করলে তারা সিয়াম পালনও করতে পারে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
إِنَّ اللهَ تَعَالَى وَضَعَ عَنْ الْمُسَافِرِ الصَّوْمَ وَشَطْرَ الصَّلاَةِ وَعَنْ الْحَامِلِ أَوْ الْمُرْضِعِ الصَّوْمَ أَوْ الصِّيَامَ
‘‘আল্লাহ রববুল ‘আলামীন মুসাফিরদের সালাত অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছেন এবং গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী নারীদের সিয়াম না রেখে পরে আদায় করার অবকাশ দিয়েছেন। (তিরমিযী : ৭১৫)
তাদের বিষয়টি সাধারণ রোগী ও মুসাফিরের সিয়ামের মাসআলার অনুরূপ।
তাছাড়া মহিলা শারীরিকভবে যদি শক্তিশালী হয় এবং সন্তানের কোন ক্ষতির আশঙ্কা না করে তাহলে সিয়াম পালন করতে পারে। আর যদি সন্তানের ক্ষতির আশঙ্কা থাকে তাহলে সিয়াম ভেঙ্গে ফেলা ওয়াজিব।


গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারিনী মহিলার ভাঙ্গা রোযার বদলে কি শুধু কাযা করবে নাকি ফিদইয়া দিবে?


শুধু কাযা করবে।


ফিদইয়ার পরিমাণ কত?


এক মুদ (৫১০ গ্রাম) পরিমাণ গম।
تُفْطِرُ وَتُطْعِمُ مَكَانَ كُلِّ يَوْمٍ مِسْكِيْنًا مُدًّا مِنْ حِنْطَةٍ
অর্থাৎ প্রতি একদিনের রোযার বদলে একজন মিসকীনকে এক মুদ (৫১০ গ্রাম) পরিমাণ গম (ভাল খাবার) প্রদান করবে। (বাইহাকী : ৪/৩৮৯)
তবে এ বিষয়ে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছ থেকে সরাসরি কোন হাদীস না থাকায় এতে অনেক মতবিরোধ রয়েছে।


গর্ভবতী নারীর পক্ষ থেকে কে ফিদইয়া দেবে?


সন্তানের পিতা বা তার ভরণ-পোষণের যিম্মাদার ব্যক্তি।


গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারী নারীরা কাযা রোযা কখন করবে?


যখন তার জন্য সহজ হবে এবং সন্তানের ক্ষতির কোন আশঙ্কা যখন থাকবে না তখন কাযা করবে।


মুসাফিরের সিয়াম

মুসাফির কাকে বলে?


যে ব্যক্তি ভ্রমণ বা সফর করে তাকে সফররত অবস্থায় মুসাফির বলে। আবার যখন নিজ বাড়ী বা বাসভবনে চলে আসে তখন শরীয়াতের পরিভাষায় তাকে বলে মুকীম। মুকীম অর্থ হলো নিজ বাসস্থানে অবস্থানকারী ব্যক্তি অর্থাৎ মুসাফির নন।


কমপক্ষে কী পরিমাণ দূরত্ব অতিক্রম করলে অর্থাৎ সফর করলে একজন ভ্রমণকারী বা যাত্রীকে মুসাফির বলা যায়?


হানাফী মাযহাবে কমপক্ষে ৪৮ মাইল। অন্যান্য মাযহাবে সফরের নিম্নতম দূরত্ব আরো কম।


মুসাফির অবস্থায় সিয়াম ও সালাতের নিয়ম কি?


মুসাফির অবস্থায় সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয এবং চার রাকআত বিশিষ্ট ফরয সালাতগুলো ২ রাকআত করে পড়বে। সে সময় ফরয নামাযের আগে বা পরে যে সমস্ত সুন্নাতে রাতেবাহ আছে সেগুলো পড়তে হবে না।


সফরে থাকা অবস্থায় সিয়াম ভঙ্গ করা জায়েয এ নিয়তে রোযার মাসে সফরে বের হওয়া কি বৈধ হবে?


এ নিয়তে সফরে বের হলে সিয়াম ভঙ্গ করা হারাম।


কোন ধরণের ভ্রমণে সিয়াম ভঙ্গ করা যাবে?


হজ্জ, উমরা, জিহাদ, পড়াশুনা, ব্যবসা, বেড়ানো, পর্যটন ইত্যাদি। তবে অধিকাংশ সত্যনিষ্ঠ আলেমদের মতে অন্যায় ও অবৈধ কাজের সফরে সিয়াম ভঙ্গ করা হারাম।


মুসাফিরের রোযা ভঙ্গ করলে পরবর্তীকালে তা কাযা করবে কি না?


হ্যাঁ, কাযা করতে হবে।
আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ فَمَن كَانَ مِنكُم مَّرِيضًا أَوۡ عَلَىٰ سَفَرٖ فَعِدَّةٞ مِّنۡ أَيَّامٍ أُخَرَۚ ﴾ [البقرة: ١٨٤] 
‘‘তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি অসুস্থ কিংবা মুসাফির সে অন্য সময় এ সংখ্যা পূরণ করে (কাযা করে) নিবে। (বাকারা : ১৮৪)


সফরে সিয়াম ভঙ্গ করা কি বাধ্যতামূলক নাকি ইচ্ছাধীন?


ইচ্ছাধীন। নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
صُمْ إِنْ شِئْتَ وَأَفْطِرْ إِنْ شِئْتَ
‘‘ইচ্ছা করলে সিয়াম পালন কর এবং চাইলে ভেঙ্গেও ফেলতে পার।’’ (মুসলিম : ১১২১)


সফরে সিয়াম পালন করা উত্তম না ভঙ্গ করা উত্তম।


মুসাফিরের জন্য যেটা সহজ সেটাই উত্তম। সফররত অবস্থায় সিয়াম পালন যদি কষ্টকর হয়ে যায় তাহলে ভেঙ্গে ফেলাই উত্তম। অতি বেশি কষ্টকরে সিয়াম পালন করা ঠিক নয়।
(ক) আল্লাহ তা‘আলা বলেন :
﴿ يُرِيدُ ٱللَّهُ بِكُمُ ٱلۡيُسۡرَ وَلَا يُرِيدُ بِكُمُ ٱلۡعُسۡرَ ﴾ [البقرة: ١٨٥] 
‘‘আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ চান, কঠিন চান না।’’ (বাকারাহ : ১৮৫)
(খ) মাক্কাহ বিজয়ের বৎসর মাক্কার উদ্দেশ্যে কুরা আলগামীম নামক স্থানে এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবাদের সামনে আসর বাদ সিয়াম ভঙ্গ করে পানি পান করলেন। (মুসলিম : ১১১৪)
(গ) জাবের রাদিয়াল্লাহু আনহু’র এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, সফরে কষ্ট হওয়ার পর ও একদল লোক সিয়াম পালন করেই যাচ্ছে। বিষয়টি জানার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন,
أُولَئِكَ الْعَصَاةُ أُولَئِكَ الْعَصَاةُ
‘‘তারা পাপী তারা পাপী।’’ (মুসলিম : ১১১৪)
উপরোক্ত হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, সফররত অবস্থায়- অতিমাত্রায় কষ্ট করে সিয়াম পালন করা পরহেজগারীর কাজ নয়, বরং এটা পাপের কাজ।
(ঘ) একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একজায়গায় কিছু মানুষের ভীড় দেখে এগিয়ে দেখলেন যে, এক লোককে ছায়া দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেলেন, সে কে? লোকেরা বলল, এ ব্যক্তি রোযাদার। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন :
لَيْسَ مِنَ الْبِرِّ اَلصِّيَامُ فِي السَّفَرِ
‘‘সফরে সিয়াম পালন করা ভাল কাজ নয়। (বুখারী : ১৯৪৬; মুসলিম : ১১১৫)
এসব দলীলের ভিত্তিতে প্রমাণিত হয় যে, সফর কষ্টকর হলে রোযা না রাখাই শ্রেয়। আর ভ্রমণ যদি খুব বেশি কষ্টের না হয় তাহলে সিয়াম পালন করাই উত্তম।


সফরে সবল ও দুর্বল ব্যক্তির সিয়ামের হুকুম কি?


সবল হলে পালন করা এবং দুর্বল হলে ভেঙ্গে ফেলা উত্তম।


সফর যদি বাড়ীতে থাকার মতই আরামদায়ক হয় তাহলে সিয়াম কি করবে?


সেক্ষেত্রে সিয়াম পালনই উত্তম। কারণ এতে অতিদ্রুত দায়িত্বমুক্ত হওয়া যায়, সকলের সাথে সিয়াম পালন হয় এবং মাসটাও থাকে ফযীলাতপূর্ণ।


মুসাফির কখন তার সিয়াম ভঙ্গ করবে?


তার গ্রাম বা মহল্লা থেকে বের হওয়ার আগে নয়। সিয়াম ভঙ্গ করতে হলে তার এলাকা থেকে বের হওয়ার পর ভঙ্গ করবে।


সূর্যাস্তের পর ইফতারী করে বিমানে আকাশে উঠে দেখল সূর্য দেখা যায়- সে কি করবে?


তার রোযা হয়ে গেছে। কাযা করার কোন কারণ নেই।


এক ব্যক্তি মুকীম অবস্থায় রোযা রাখল। অতঃপর দিনের বেলায় সফর শুরু করল। সে কি করবে?


ইচ্ছা করলে রোযা ভঙ্গতে পারবে।


সফরই যাদের চাকুরী যেমন ডাক বিভাগের কর্মচারী; বাস ও ট্রেনের ড্রাইভার, বিমানের পাইলট ও জাহাজের নাবিক তারা কি করবে?


তারা রোযা ভঙ্গ করতে পারবে। তবে তাদেরকে পরে অবশ্যই কাযা আদায় করতে 
 
 

কেউ যদি এক দেশে রোযা রাখে অতঃপর ভিন্ন রাষ্ট্রে চলে যায় তাহলে রোযা শুরু বা শেষ কোন দেশের সময় অনুযায়ী করবে?


যখন যে দেশে অবস্থান করবে সে দেশের লোকদের সাথে ঐ দেশের সময় অনুযায়ী রোযা রাখবে ও ঈদ পালন করবে। তারপর যদি রোযার সংখ্যা ২৯ এর কম হয় তবে ঈদের পরে ১দিন কাযা করবে।


অসুস্থ ব্যক্তি সুস্থ হয়ে এবং মুসাফির মুকীম হয়ে কিছুদিন অবস্থান করার পর মারা গেলে তাদের কাযার ফায়সালা কি?


সুস্থ এবং মুকীম অবস্থায় যে কয়দিন জীবিত ছিল সে কয়দিনের রোযার কাযা ওয়াজিব হবে। যেমন কোন রুগ্ন ব্যক্তি অসুস্থ অবস্থায় ১০টি রোযা ছেড়ে দিল এবং সুস্থ হয়ে ৫দিন অবস্থানের পর মারা গেল উক্ত ব্যক্তির উপর ৫ দিনের ৫ টি রোযার কাযা ওয়াজিব হবে। অতএব, উক্ত দিনের রোযা না রাখলে ফিদইয়াহ আদায়ের জন্য অসিয়ত করলে মৃত ব্যক্তির মাল হতে ফিদইয়াহ আদায় করা ওয়াজিব। কিন্তু অসিয়ত না করলে ওয়াজিব হবে না বরং মুস্তাহাব হবে।